ভাইফোঁটা (Bhai Phota) : এক ঐতিহ্যবাহী হিন্দু উৎসবের রঙিন অনুষঙ্গ
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হল একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু উৎসব যা কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে উদযাপিত হয়। পশ্চিম ভারতে এটি ভাইদুজ নামে পরিচিত এবং দীপাবলির শেষ দিনে এটি পালিত হয়। আবার মহারাষ্ট্র, গোয়া এবং কর্ণাটকে এই উৎসবটি ভাইবিজ নামে উদযাপন করা হয়। এছাড়াও নেপাল ও দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে একে ভাইটিকা নামে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।
কিংবদন্তী
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, মৃত্যুর দেবতা যম এই দিনে তার বোন যমুনার আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে যান। যমুনা যমকে আতিথেয়তা করে এবং আশীর্বাদ চায় যে এই দিনে ভাই তার বোনের বাড়ি এলে তার অকালমৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে না। তাই এই তিথি থেকেই ভাইফোঁটা বা যম দ্বিতীয়ার উৎপত্তি হয়। অনেকেই মনে করেন, কৃষ্ণ রাক্ষস নরকাসুরকে বধ করার পর তাঁর বোন সুভদ্রা তাকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে বরণ করে তার কপালে তিলক দেন, এই ঘটনাও ভাইফোঁটার আরেকটি প্রাচীন প্রেক্ষাপট।
ভাইয়াদুজ : ভাই-বোনের চিরন্তন বন্ধনের উৎসব
ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যে একটি বিশেষ সংযোগ থাকে। তারা একে অপরের সেরা বন্ধু, সুরক্ষাকর্তা, গোপন কথা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গী এবং পরম ভালোবাসার উৎস। এই সম্পর্কের অনুভূতি এবং আবেগ সহজে প্রকাশ করা যায় না। তবে কিছু বিশেষ উৎসব আছে যেগুলি ভাই-বোনের মধ্যে সেই মধুর সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। ভাইয়াদুজ সেই বিশেষ দিনগুলির একটি, যেখানে বোনেরা তার প্রিয় ভাইয়ের দীর্ঘায়ু, সুস্থতা এবং সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে।
ভাইয়াদুজ মূলত দীপাবলির পরে দ্বিতীয় দিনে পালিত হয়, যা কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আসে, অর্থাৎ অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে। ২০২৪ সালে, ভাইয়াদুজ ৩রা নভেম্বর রবিবার পালিত হবে।
উৎস, অর্থ ও গুরুত্ব
উৎস
ভাইয়াদুজ বা ভাই ফোঁটা মূলত ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদযাপিত হয় এবং এটি পাঁচদিনব্যাপী দীপাবলি বা তিহার উৎসবের শেষ দিন। এটি দক্ষিণ ভারতের কিছু অঞ্চলে যম দ্বিতীয়া নামেও পরিচিত।
এটি নিয়ে কয়েকটি পুরাণের গল্প প্রচলিত আছে। এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুষ্ট রাক্ষস নরকাসুরকে বধ করার পর তার বোন সুভদ্রার কাছে যান। সুভদ্রা তাকে ফুল ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করে এবং তার কপালে তিলক দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এই ঘটনা থেকেই ভাইয়াদুজ উৎসবের জন্ম হয় বলে ধারণা করা হয়।
আরেকটি গল্পে বলা হয়েছে মৃত্যুর দেবতা যম এবং তার বোন যমুনার কথা। বলা হয়, যম তার বোনের সঙ্গে দেখা করতে কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিনে আসেন। এই দিনের পর থেকেই যম দ্বিতীয়া বা যম দ্বিতীয়া নামের উৎসবটি উদযাপিত হতে শুরু করে।
অর্থ ও গুরুত্ব
ভাইয়াদুজ নামের মধ্যেই এই উৎসবের মূল অর্থ লুকিয়ে আছে। “ভাই” অর্থাৎ ভাই এবং “দুজ” অর্থাৎ অমাবস্যার পরের দ্বিতীয় দিন। তাই এই দিনটি ভাই-বোনের সম্পর্ককে উদযাপনের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই দিনটি ভাই-বোনের জীবনে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এটি একটি পবিত্র দিন যা দুই বিপরীত লিঙ্গের ভাই-বোনের সম্পর্ককে সেলিব্রেট করে। বোনেরা এই দিনে তাদের ভাইকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের পছন্দের খাবার রান্না করে পরিবেশন করে। বোনেরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যেন ভাইদের সকল বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখা হয় এবং তাদের দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধি কামনা করে। এর বিনিময়ে, ভাইও তার বোনকে স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তার দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে।
ভাইয়াদুজ উৎসবটি শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি এক গভীর বন্ধনের প্রতীক। এই দিনে ভাই ও বোনের সম্পর্ক আরও দৃঢ় ও গভীর হয়।
বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্য
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামে এই উৎসবটি পালিত হয়:
- ভাই দুজ: উত্তর ভারতে দিওয়ালি উৎসবের সময় এটি পালন করা হয়। উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কিছু অঞ্চলে একে ভাইয়া দুজও বলা হয়।
- ভাই টিকা: নেপালে এটি “তিহার” নামে পরিচিত। বোনেরা ভাইদের কপালে সাত রঙের টিকা লাগিয়ে দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে।
- বাংলায় ভাই ফোঁটা: পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশে কালীপূজার দ্বিতীয় দিনে এটি পালিত হয়। এখানে বোনেরা শঙ্খ বাজিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেয় এবং বিভিন্ন মিষ্টি দ্বারা মিষ্টিমুখ করায়।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ধাপ
উৎসবের দিনে বোনেরা তাদের ভাইদের জন্য নানা প্রিয় খাবারের আয়োজন করে। চন্দন কাঠ ও জল মিশিয়ে ফোঁটা তৈরি করা হয় এবং বোন তার ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে বলে:
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর,
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥
এই সময় বোন ভাইয়ের মাথায় ধান ও দুর্বা ঘাস রেখে আশীর্বাদ করে এবং ভাইও উপহার দেয়। অনুষ্ঠান শেষে পরিবারের সবাই মিলে আনন্দ উদযাপন করেন।
ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভাইফোঁটার পালন
- বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে: ভাইফোঁটার উৎসবে পরিবারের সদস্যরা মিলিত হয়ে ঘরোয়া পরিবেশে একে অপরকে আশীর্বাদ ও উপহার প্রদান করে।
- মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে ভাই বিজ: এখানে ভাই-বোনেরা বিশেষভাবে মিলিত হয়ে আনন্দ ও আতিথেয়তার সাথে উপভোগ করেন।
- নেপালে ভাই টিকা: নেপালে তিহার উৎসবের পঞ্চম দিনে বোনেরা ভাইয়ের কপালে সাত রঙের টিকা দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করে এবং ফুলের মালা উপহার দেয়।
উপসংহার
ভাইফোঁটা শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি হল ভাই-বোনের সম্পর্কের পবিত্রতার প্রতীক। এই উৎসবটি পারস্পরিক ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধন আরও দৃঢ় করে তোলে।
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.