Bibhutibhushan Bandopadhyayবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী

Bibhutibhushan Bandopadhyay


‘গৌরীকে দেখাবেন? আমার গৌরি! একটিবার শুধু দেখা করিয়ে দিন! – ভাবছেন কার কথা বলছি তাহলে যেন  নেই উনি হলেন গ্রাম্যপল্লী জীবনের গৌরী প্রেমিক স্বামী তথা অসামান্য কথা শিল্পী উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

” মুনির চিন্তা মনি, নাই অন্য আশা। “

নিষ্কর্মার লোকের চিন্তা তার তাশ আর  পাশা।

ধনীর চিন্তা ধন আর নিরেনব্বই এর ধাক্কা,

যোগীর চিন্তা জগন্নাথ, ফকিরের চিন্তা মক্কা,

গৃহস্থের চিন্তা বজায় রাখতে চারি চালের ঠাটটা

শিশুর চিন্তার সদাই মাকে, পশুর চিন্তা পেটটা |

– বন্দ্যোপাধ্যায় .

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মান জানিয়ে আজকের তারই জীবনই আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। 

জন্ম এবং বংশ পরিচয়: 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২ ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতের বাংলা প্রদেশের ২৪ পরগনা জেলার কাঁচরা পাড়ার সন্নিকট ঘোষপুর – মুড়াপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতা ছিলেন মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি পেশায় একজন প্রখ্যাত সংস্কৃত বিষয়ক পন্ডিত। মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় পাণ্ডিত্য কথ কতার  জন্য শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

শিক্ষাজীবন: 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষা শুরু হয় পিতা এর কাছে হাতেখড়ি শিক্ষার মাধ্যমে লেখাপড়ার পাঠ শুরু করেন। ছোট থেকে মেধাবী হওয়ার কারণে নিজের  গ্রামে পাঠশালায় পড়াশোনার পর বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বনগ্রাম হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা রিপন কলেজ (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আই এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকেই বিএ পরীক্ষার ডিস্টিংশন সহ উত্তীর্ণ হয় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য এম এ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন। পরিবারের চাপে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি।

কর্মজীবন: 

হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপরে সোনারপুর হরিনাভী স্কুলেও শিক্ষকতা করেন। এই সময়ে গৌরী দেবীর মৃত্যু হলে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং গোরক্ষিনী সভার প্রচারক কোন হিসাবে বাংলা ত্রিপুরা আরকানের বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণ করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে খেলৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহ শিক্ষকতা ও সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন, সোনার সুপারিশ ক্রমে ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ভাগলপুরে প্রবাসী হিসেবে বসবাস করতে থাকেন, এখান থেকেই তার অমর উপন্যাস শুরু হয় ‘ বিভূতিভূষণ এর প্রথম উপন্যাস হল  ‘পথের পাঁচালী’ এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর ধর্ম তলায় খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের শিক্ষকতা করেন। পরে বোনকার নিকট গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনের  পর্যন্ত শিক্ষকতা করতে থাকেন।

Bibhutibhushan Bandopadhyay
Bibhutibhushan Bandopadhyay

সাহিত্য চর্চা: 

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় উপেক্ষিতা নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে বসবাস কালীন সময়ে তার সাহিত্য অমর উপন্যাস পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন। ১৯২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যিক সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মাসিক ‘ বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশ করলে জনসমাজের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় প্রথম ও সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকৃতী  যা পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘ পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কিশোর পাঠ্য ‘ চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস ভারতবর্ষে তরুণদের কাছে অতি জনপ্রিয় রোমাঞ্চকর উপন্যাস।

রচনা সামগ্রী: 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস গুলি হল-

•উপন্যাস:

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, দৃষ্টি প্রদীপ, অরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিপিনের সংসার, দুই বাড়ি, ইচ্ছামতী, দেবজান, কেদার রাজা, অশনি সংকেত, দম্পতি ইত্যাদি।

• গল্প সংকলন:

মেঘমোল্লা, মৌরি ফুল, যাত্রাবদল, জন্ম মৃত্যু, নবাগত, তালনবমী, অসাধারণ, বিধু মাস্টার, উপলখণ্ড, জ্যোতিলিঙ্গন, অনুসন্ধান, ছায়াছবি ইত্যাদি।

• কিশোর পাঠ্য:

চাঁদের পাহাড়, হিরা মানিক জ্বলে, ইত্যাদি

• ভ্রমণ মূলক কাহিনী:

অভিযাত্রিক, স্মৃতির লেখা, হে অরণ্যক কথা ইত্যাদি।

পুরস্কার ও সম্মাননা: 

বিখ্যাত উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতী উপন্যাসের জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এছাড়া ওনার জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমা পরমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রাখা হয়েছে।

মহাপ্রয়ান: 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবনের কয়েকটি বছর তার অতি প্রিয় কৃত্তিভূমি ব্যারাকপুর ও তার ভালোবাসার শেষ চিহ্ন গৌরিকুঞ্জতে কাটিয়েছেন। এই সময়ে তিনি সাহিত্যচর্চায় যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ১লা সেপ্টেম্বর বিখ্যাত উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বিহারের ঘাটশিলায় (অধুনা ঝাড়খণ্ডের ) জেলার অংশে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন।

” মা ছেলেকে স্নেহ দিয়া মানুষ করিয়া তোলে, যুগে যুগে মায়ের গৌরব গাঁথা তাই সকল জনমের বার্তায় ব্যক্ত। কিন্তু শিশু যা মাকে দেয়, তাই কি কম? সে নিঃস্ব আসে বটে, কিন্তু তার মন- কাড়িয়া -লওয়া হাসি, শৈশবতারল্য চাঁদ ছনিয়া গড়া মুখ , আধ  আধ  আবোল – তাবোল বকুনির দাম কে দেয়? ওই তার ঐশ্বর্য, ওরি বদলে সে সেবা  নেয়, রিক্ত হাতে ভিক্ষুকের মত নেয় না”। বল্লালী – বালাই ( পথের পাঁচালী) অংশ থেকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় যেভাবে অংশটি তুলে ধরেছেন। আজও আমাদের কে শিহরিত করে তোলে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে আছেন অমর হয়ে থাকবেন আজীবন।


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content