Fateha-e-YazdahamFateha-e-Yazdaham

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম এবং ফাতেহা দোয়াজ দাহাম : ইতিহাস, গুরুত্ব, তারিখ, প্রভাব এবং উদযাপন

বিস্তারিত দেখার জন্য নিচের বিষয়বস্তুর ওপর ক্লিক করুন

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম

ইতিহাস, গুরুত্ব, তারিখ, প্রভাব এবং উদযাপন

Fateha-e-Yazdaham

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম (ফার্সি শব্দ “ফাতেহা” মানে মৃতের জন্য প্রার্থনা এবং “ইয়াজদাহাম” মানে এগারো) মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রদ্ধেয় দিন, বিশেষ করে সুফি এবং সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। দিনটি হযরত সাইয়েদ মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.), যিনি “গাউসুল আজম” বা “বড় পীর” হিসেবে পরিচিত, তার স্মরণে পালিত হয়। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) ৫৬১ হিজরি (১১৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সালের ১১ রবিউস সানি মাসে ইন্তেকাল করেন। তাকে স্মরণ করে প্রতি বছর মুসলিমরা ১১ রবিউস সানি তারিখে ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম পালন করে থাকে।

ইতিহাস:

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) ইসলামের ইতিহাসে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১ লা রমজান, ৪৭০ হিজরিতে ইরাকের বাগদাদের উত্তরে প্রায় ৪০০ মাইল দূরে জিলান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হযরত সৈয়দ আবু সালেহ মুসা এবং মাতা উম্মুল খায়ের ফাতেমা ছিলেন ইসলামের মহান ব্যক্তিত্বদের উত্তরাধিকারী। পিতৃ এবং মাতৃ উভয় দিক থেকেই তিনি হযরত আলী (রা.)-এর বংশধর ছিলেন, এ কারণে তাকে “আল-হাসানি ওয়া আল-হুসাইনি” বলা হয়।

শৈশব থেকেই তিনি অসাধারণ চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। একবার তিনি বাগদাদে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে গোপনে ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে রওনা হন। পথে ডাকাতেরা আক্রমণ করে এবং যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি সত্য কথা বলেছিলেন যে তার কাছে ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তার এই সত্যবাদিতা দেখে ডাকাতরা এতটাই বিস্মিত হয় যে তারা সমস্ত লুট করা সম্পদ ফেরত দেয় এবং ইসলামে দীক্ষিত হয়। তার এই ঘটনাটি তার সৎ ও নৈতিকতার পরিচায়ক।

গুরুত্ব:

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম মুসলিমদের কাছে একটি বিশেষ দিন, বিশেষ করে সুফি তরিক্বতের অনুসারীদের জন্য। এই দিনটি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পালিত হয়, যিনি তার তরিক্বতের মাধ্যমে ইসলামিক আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তার শিক্ষায় আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস এবং মানবসেবার কথা উল্লেখ রয়েছে, যা আজও মুসলমানদের জন্য প্রাসঙ্গিক।

তারিখ:

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম প্রতি বছর ইসলামী (হিজরি) ক্যালেন্ডারের রবিউস সানি মাসের ১১ তম দিনে পালিত হয়। এই দিনটি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর ইন্তেকালের স্মরণে মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে পালিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ প্রতিবছর পরিবর্তিত হয়, কারণ এটি চাঁদ নির্ভর ক্যালেন্ডার।

প্রভাব:

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম দিনের প্রভাব সুফি দর্শনের মাধ্যমে ইসলামের আধ্যাত্মিকতার উপর দৃঢ়ভাবে প্রভাব ফেলে। এই দিনে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং মানবতার কল্যাণের উপর গুরুত্ব দেয়। তার শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য আজও তার প্রভাব প্রচলিত রয়েছে। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) তার জীবদ্দশায় হাজার হাজার মানুষকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, যা ইসলামের ইতিহাসে তার অমর অবদান হিসেবে চিহ্নিত।

উদযাপন:

ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম উদযাপনের মূল রীতি হলো কোরআন খতম, দোয়া মাহফিল, এবং মিলাদ। বাংলাদেশসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে, বিশেষত উপমহাদেশের ভারত-পাকিস্তান অঞ্চলে এবং আফগানিস্তান, ইরানে এই দিনটি গভীর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়। এই দিন উপলক্ষে মসজিদে মাগরিবের পর ওয়াজ, মিলাদ এবং বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। অনেক খানকাহ এবং দরগাহতে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন সামাজিক কাজ করা হয়।

ইমামুল আউলিয়া:

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) ইসলামের আধ্যাত্মিক জগতের একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাকে ইমামুল আউলিয়া বা আউলিয়াদের ইমাম বলা হয়। তার বক্তব্য এবং ধর্মীয় শিক্ষা এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে তিনি কোটি কোটি মানুষকে ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তার মৃত্যুর পরে, তিনি মুসলিম বিশ্বের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

সারা জীবন ইসলামের প্রচার ও মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য তিনি সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেন। ৯১ বছর বয়সে তিনি ৫৬১ হিজরি সালের ১১ রবিউস সানি মাসে ইন্তেকাল করেন এবং তার মৃত্যুর দিনটি ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম নামে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকে।

ফাতেহা দোয়াজ দাহাম : ইতিহাস, গুরুত্ব, তারিখ, প্রভাব এবং উদযাপন

ফাতেহা-দোয়াজদাহাম (ফার্সি শব্দ “ফাতেহা” অর্থ মোনাজাত, দোয়া, বা প্রার্থনা এবং “দোয়াজদাহাম” অর্থ বারো) মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে পালিত একটি পবিত্র দিন। এই দিনটি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন তার শান্তি কামনায় জন্য হয়। মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এই দিনে মুসলমানরা আল্লাহর নিকট বিশেষ প্রার্থনা করেন এবং মহানবীর স্মরণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করে থাকেন।

ইতিহাস:

ফাতেহা-দোয়াজদাহামের সাথে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত। বলা হয়, এই দিনটিতেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের প্রধান পয়গম্বর ও আল্লাহর প্রেরিত দূত হিসেবে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন এবং মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করেন।

ইতিহাস অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমিনার গর্ভে আসেন এবং ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে ভূমিষ্ঠ হন। তবে সকল ঐতিহাসিকের মধ্যে এই বিষয়ে একমত রয়েছে যে, মহানবীর জন্মবার ছিল সোমবার। তার জন্মের পরই মক্কার শুষ্ক মরুভূমি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, এবং গাছপালায় প্রচুর ফুল ও ফল ধরেছিল বলে কথিত আছে। সেই কারণে কোরাইশ সম্প্রদায় সেই বছরকে “আনন্দ ও খুশির বছর” হিসেবে আখ্যায়িত করে।

গুরুত্ব:

ফাতেহা-দোয়াজদাহামের মূল গুরুত্ব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উদযাপন করা। তার জন্মের দিনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি ইসলাম ধর্মের প্রধান প্রতীক এবং মানবতার পয়গম্বর। ইসলামের শিক্ষাগুলো মানবজাতির জন্য শান্তি, ন্যায় এবং সমতার বার্তা বহন করে।

তবে ইসলামী রীতি অনুসারে জন্ম ও মৃত্যু দিবস বিশেষভাবে উদযাপন করা নিষিদ্ধ। তাই ফাতেহা-দোয়াজদাহামের দিনটি সাধারণত অনাড়ম্বরভাবে পালন করা হয়। মুসলমানরা এদিন কোরআন পাঠ, তসবী এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করে নবীর প্রতি সম্মান জানায়।

তারিখ:

ফাতেহা-দোয়াজদাহাম প্রতি বছর ইসলামী হিজরি ক্যালেন্ডারের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে পালিত হয়। এই দিনটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পরিচিত এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যদিও মহানবীর সঠিক জন্মতারিখ নিয়ে কিছু মতবিরোধ রয়েছে, তবে ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে, এই দিনটি নবীর জন্মের দিন হিসেবে এবং মৃত্যু দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।

প্রভাব:

ফাতেহা-দোয়াজদাহামের প্রভাব মুসলিম সমাজের মধ্যে আধ্যাত্মিক জাগরণের সৃষ্টি করে। এই দিনটি মুসলমানদের ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোতে ফিরে আসতে এবং আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি প্রদর্শন করতে উদ্বুদ্ধ করে। মহানবীর জীবনের উদাহরণ এবং তার শেখানো নীতি অনুযায়ী জীবন যাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয়।

নবীর স্মরণে এই দিন মুসলমানরা তাদের জীবনে নতুন করে আত্মশুদ্ধি ও সৎপথে চলার প্রতিজ্ঞা করে। তার শিক্ষা মানুষকে দয়া, ন্যায়বিচার, সেবা এবং সৎভাবে জীবন যাপনের অনুপ্রেরণা দেয়।

উদযাপন:

ফাতেহা-দোয়াজদাহামের উদযাপন প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। মুসলিমরা এদিন কোরআন খতম, মিলাদ মাহফিল, এবং বিশেষ দোয়ার আয়োজন করে। মসজিদ এবং খানকাহগুলোতে নবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইসলামের নীতি ও আদর্শের উপর আলোচনা ও বক্তব্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।

মুসলিম সম্প্রদায় এদিন দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ করে এবং সমাজসেবামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ফাতেহা-দোয়াজদাহাম উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।

নবী দিবস এবং ইসলামের শিক্ষা:

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সাথে সাথে ইসলামের নতুন যুগের সূচনা হয়। তার শিক্ষাগুলো সারা বিশ্বের মানুষের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং কল্যাণের পথ দেখায়। মহানবীর জন্মের মাধ্যমে মক্কার মরুভূমি যেমন সজীব হয়ে উঠেছিল, তেমনই তার জীবন ও শিক্ষার মাধ্যমে মানবজাতির জন্য একটি নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছিল।

মহানবী ছিলেন অত্যন্ত সরল এবং দানশীল। কথিত আছে, তিনি খুব কম খেতেন এবং অধিকাংশ সময় খেজুর ও পানি খেয়ে জীবনযাপন করতেন। তার চরিত্রের এই দিকগুলো তার জীবনের গভীরতা ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তার শিক্ষা আজও মুসলমানদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার:

ফাতেহা-দোয়াজদাহাম দিনটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তার শিক্ষার প্রতি মুসলিমদের আনুগত্যের প্রকাশ। এই দিনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য, শান্তি এবং আধ্যাত্মিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হিসেবে উদযাপিত হয়।


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content