জগদ্ধাত্রী পূজা : একটি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ২০২৪-এর পূজা নির্ঘন্ট
Jagaddhatri Puja
ভূমিকা: বাংলা সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ জগদ্ধাত্রী পূজা। দেবী দুর্গার পরবর্তী সময়ে বাংলার মানুষের মাঝে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে জগদ্ধাত্রী পূজা। এই পূজা মূলত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চন্দননগরে বিশেষভাবে উদযাপিত হলেও, বাংলার নানা প্রান্তে এটি সমান গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। দেবী জগদ্ধাত্রীকে শক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এবং এই পূজার মাধ্যমে আত্মশক্তি এবং ধৈর্যের উদযাপন করা হয়।
জগদ্ধাত্রী পুজো কেন করা হয়?
জগদ্ধাত্রী পূজার মূল উদ্দেশ্য হল শক্তি এবং ধৈর্যের পূজার মাধ্যমে মানবজাতিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। “জগদ্ধাত্রী” শব্দটির অর্থ “বিশ্বের ধারক” বা “বিশ্বকে রক্ষা করার শক্তি,” এবং দেবী জগদ্ধাত্রীকে মা দুর্গার রূপ হিসেবে ধরা হয়, যিনি মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সংকল্পের প্রতীক হিসেবে বিরাজ করেন।
পুরাণ মতে, দেবী দুর্গা যখন অসুরদের বধ করতে আসেন, তখন তিনি পরম শক্তির অধিকারিণী হন। কিন্তু এই বিশাল শক্তি ধারণ করার জন্য তাঁর নিজের মধ্যেও ভরসা ও স্থৈর্যের প্রয়োজন হয়। দেবী জগদ্ধাত্রী সেই আত্মশক্তিরই প্রতীক, যিনি বিশ্বাস, সহমর্মিতা, এবং ধৈর্যের বার্তা দেন।
বিশ্বাস করা হয় যে, এই পূজার মাধ্যমে জীবনের নানা সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করার জন্য দেবী ভক্তদের শক্তি, সাহস এবং ধৈর্যের আশীর্বাদ প্রদান করেন।
মা জগধাত্রী রূপ বর্ণনা এবং তার সাথে থাকা সমস্ত জীবের বিস্তারিত বিবরণ। :
মা জগদ্ধাত্রীকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত এক দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়, যিনি ত্রিনয়না, অর্থাৎ তিন চোখ বিশিষ্টা। তাঁর গায়ের রঙ অপরূপ গৌরবর্ণ, যা দেবী দুর্গার মতোই শুভ্রতা ও শুদ্ধতার প্রতীক। দেবীর চতুর্ভুজ বা চারটি হাত রয়েছে, এবং প্রতিটি হাতে তিনি বিভিন্ন অস্ত্র ও প্রতীক ধারণ করেন। সাধারণত, দেবীর ডান হাতে চক্র ও ত্রিশূল এবং বাম হাতে শঙ্খ ও ধনুক থাকে। এই অস্ত্রগুলি তাঁর শক্তি, শুদ্ধতা, জ্ঞান, এবং সতর্কতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত।
দেবী জগদ্ধাত্রী একটি সিংহের উপর বসে থাকেন। সিংহ তাঁর অপরাজেয় শক্তির প্রতীক হলেও, দেবী যে জীবতত্ত্বের ধারক, তা বোঝাতে তাঁর পায়ের নিচে এক দানবাকৃতির মদন কামিনী উপস্থিত। এই দানবকে দেবীর পায়ের নিচে দেখানো হয়, যা তাঁর সমস্ত দানবিক শক্তিকে বিনাশের প্রতীক। এভাবে দেবী জগদ্ধাত্রী এই পূজার মাধ্যমে দানবিক প্রবৃত্তিগুলিকে দমন এবং মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ করেন।
ইতিহাস: জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস বহু পুরনো। কথিত আছে, ১৭৫০ সালের দিকে চন্দননগরের জমিদার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রথম এই পূজার সূচনা করেন। দেবী জগদ্ধাত্রীকে দুর্গার অবতার হিসাবে কল্পনা করা হয়, এবং মনে করা হয় তিনি মানবতার রক্ষা ও শক্তির উৎস। এই পূজা আদি কাল থেকেই আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল, এবং বিশেষ করে রাজা-মহারাজাদের মধ্যে পূজা করার প্রবণতা ছিল। চন্দননগরেই মূলত এই পূজার বিশেষ উৎসব পালন শুরু হয় এবং তা আজও সমান উৎসাহে পালিত হয়।
কোথায় এবং কবে পূজা শুরু হয়েছে: জগদ্ধাত্রী পূজা পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর থেকে শুরু হয়েছে। বিশেষত, চন্দননগরের জমিদার শ্রেণির মানুষরা প্রথম এই পূজার প্রচলন করেন। ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়। বর্তমানে চন্দননগরের পাশাপাশি শ্রীরামপুর, হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, কলকাতা, এমনকি বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলেও এই পূজা পালিত হয়।
পূজার দিনক্ষণ: কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি দুর্গাপূজার এক মাস পর উদযাপিত হয় এবং দেবী দুর্গার মতোই মহাসমারোহে পালন করা হয়। পণ্ডিতদের মতে, মহাষ্টমী, নবমী এবং দশমী তিন দিন ধরে পূজা চলতে থাকে, এবং দশমীর দিন দেবীর বিসর্জন সম্পন্ন হয়।
২০২৪ সালে জগদ্ধাত্রী পূজার নির্ঘন্ট: ২০২৪ সালে জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হবে ৯ নভেম্বর। ৮ নভেম্বর হবে মহাষ্টমী এবং ১০ নভেম্বর দশমী ও বিসর্জনের দিন। পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে চন্দননগরে আলোকসজ্জা, বিশাল মণ্ডপ এবং প্রতিমা শোভাযাত্রার মাধ্যমে এই পূজা পালিত হয়।
২০২৪ সালের জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু শুরু হয়ে গেছে। এবারের পূজার অষ্টমী তিথি শনিবার এবং নবমী তিথি রবিবারে পড়েছে, যা ছুটির দিনে হওয়ায় পূজার উদযাপন আরও বিশেষ হয়ে উঠবে। নিচে পূজার প্রতিটি তিথি তালিকাভুক্ত করা হলো:
তিথি | তারিখ | বার |
---|---|---|
পঞ্চমী | ৬ নভেম্বর, ২০২৪ | বুধবার |
ষষ্ঠী | ৭ নভেম্বর, ২০২৪ | বৃহস্পতিবার |
সপ্তমী | ৮ নভেম্বর, ২০২৪ | শুক্রবার |
অষ্টমী | ৯ নভেম্বর, ২০২৪ | শনিবার |
নবমী | ১০ নভেম্বর, ২০২৪ | রবিবার |
দশমী | ১১ নভেম্বর, ২০২৪ | সোমবার |
এই নির্ঘন্ট অনুযায়ী, জগদ্ধাত্রী পূজার গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি ছুটির দিনেই পড়েছে, যা পূজার উদযাপনে ভক্তদের জন্য বিশেষ আনন্দ বয়ে আনবে।
শুভেচ্ছা বার্তা: এই পূজার দিনে সকলকে জানাই জগদ্ধাত্রী পূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা। দেবী জগদ্ধাত্রী সকলের জীবনকে শক্তি, সাহস এবং সৌহার্দ্যে পরিপূর্ণ করুন। দেবীর আশীর্বাদে সকলের মঙ্গল ও উন্নতি হোক।
উপসংহার: জগদ্ধাত্রী পূজা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। এই পূজা নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমাদের ঐতিহ্যের বীজ বপন করে। চন্দননগরের এই আলোকোজ্জ্বল পূজা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আত্মশক্তির গুরুত্ব, এবং মানবতার জন্য সহানুভূতির আহ্বান জানায়।
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.