ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ এর জীবনী
BIOGRAPHY OF JANSHI RANI LAKSMI BAI
ভূমিকা:
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। যাকে আমরা ঝাঁসির রানী বা ঝাঁসি রানী লক্ষ্মীবাঈ নামে বেশি জানি। ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের অন্যতম পথিকৃৎ ও প্রতিমূর্তি হলেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ। রানীর নামটিতেও রয়েছে সাহস ও বীরত্বের নিদর্শন। ভারতের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে তিনি তার বড় অবদান রেখেছিলেন। তার জীবনের শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। তার বাণী
“যদি যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত ও নিহত হই তবে আমরা অবশ্যই অনন্ত গৌরবে সঙ্গে সেই মৃত্যুবরণ করবো। ইতিহাসের পাতায় এক সাহসী নারীর জীবনী আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
জন্ম পরিচয়:
ঝাঁসিরানী লক্ষ্মীবাঈ মারাঠি কারাডে ব্রাহ্মণ পরিবারের 19 শে নভেম্বর, ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে বারানসি কাশী এলাকায় ঝাঁসি রানী লক্ষ্মীবাঈ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল মরুপান্ত তাম্বে। এবং তার মাতার নাম ছিল ভাগীরথী বাঈ তাম্বে। জন্মের পর ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম রাখা হয়েছিল মনিকর্নিকা তাম্বে। এবং বাড়ির আদরের নাম রাখাাা হয়েছিল মনু। তার বাবা ‘ ছাবিলি’ নামেও ডাকতেন। দুর্ভভাগ্য ক্রমে মাত্র চার বছর বয়়সে ছোট্ট মনু মাতৃহারা হয়। করে তার পিতা তাকে লালন পালন করতেন।
শিক্ষাজীবন:
পিতা মরুপান্ত তাম্বে কোর্টের কাজকর্ম জড়িত থাকার কারণে। মনু এই সময়কার অন্যান্য নারীদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময় তিনি আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাবের পাশাপাশি ঘোড়া চালানোর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ এর প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। তিনি পড়তে এবং লিখতে সক্ষম ছিলেন। সমসাময়িক নারীদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি স্বাধীন ও দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বাল্যকাল থেকেই নানা সাহেব ও তাতিয়া টোপির কাছে তলোয়ার চালানো এবং তীরন্দাজী শিখেছিলেন। এছাড়াও তিনি তার বান্ধবীদের নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।
বৈবাহিক জীবন:
ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়াল সঙ্গে ১৮৪২ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে রানী লক্ষ্মীবাঈয় বিবাহ হয়। ঝাঁসিতে যাওয়ার পর সেখানে তার নতুন নাম করা হয়, নাম দেয়া হয় লক্ষ্মীবাঈ। রাজা গঙ্গাধর এর আগেও একজন স্ত্রী ছিলেন। যিনি ইচ্ছায় নিঃসন্তান অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৮৫১ সালে রানী লক্ষ্মীবাঈ এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তার নাম রাখা হয়েছিল’দামোদর রাও’ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সন্তানটি মাত্র চার মাস বেঁচে ছিল। এদিকে রাজা গঙ্গাধর এর বয়স বেড়ে যাচ্ছিল তাই তারা তাদের এক আত্মীয়র সন্তানকেই দত্তক নিয়ে নেন এবং তার পরিবর্তন করে নতুন রাম রাখেন। ১৮৫৩ সালে গঙ্গাধর রাও প্রাণ বিয়োগ ঘটে।
স্বত্ববিলোপ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ:
তৎকালীন জেনারেল লর্ড ডালহৌসি নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝাঁসিতে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে। এই নীতি অনুযায়ী, কোন একটি রাজ্যের রাজা যদি নিজের রক্তের সম্পর্কে কাউকে উত্তরাধিকারী হিসাবে না রেখে যায়, তবে সেই রাজ্যটি সক্রিয়ভাবেই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু এই নীতির বিরুদ্ধে রানী লক্ষ্মীবাঈ তীব্র প্রতিবাদ জানান। এই নীতির অধীনে দামোদার রাও সিংহাসনের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। কারণ তিনি দত্তপুত্র ছিলেন। ১৮৫৪ সালে মার্চ মাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈকে বাৎসরিক ৬০০০০ টাকার চুক্তিতে রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গ ছেড়ে দেয়ার শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু লক্ষীবাই কোনভাবেই ঝাঁসিকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি তার বিরোধীতার করে গর্জে ওঠেন।
মহাবিদ্রোহে লক্ষ্মীবাঈ ভূমিকা:
১০ই মে ১৮৫৭ সাল। এই দিনটি মিরাটে ভারতীয় বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এন্ডফিল রাইফেলের আচ্ছাদনে শূকরের মাংস এবং গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়। এ কথা জানার পর ভারতীয় সেনারা উক্ত রাই ফেলে ব্যবহারের অসম্মতি জানায়, কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দেয় যে যারা অসম্মতি জানাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই বিদ্রোহে অনেক ব্রিটিশ সৈন্যসহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের হত্যা করে সিপাহীরা। ওই সময়ের লক্ষীবাঈ তার বাহিনীকে নিরাপদে ও অক্ষত অবস্থায় ঝাঁসি ত্যাগ করাতে পেরেছিলেন।। সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী প্রবল গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে। লক্ষ্মীবাঈ একাকী ঝাঁসি ত্যাগ করেন। তার নেতৃত্বে ঝাঁসির শান্ত ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় ছিল। তার আয়োজিত হলদি কুমকুম অনুষ্ঠানে ঝাঁসির রমনীরা শপথ নিয়েছিলেন যেকোনো আক্রমণ কি তারা মোকাবিলা করবে ভয় না পেয়ে। ১৮৫৭ সালের ৮ই জোখন বাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা সহ স্ত্রী সন্তানদের উপর গণহত্যার বিষয়ে তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। অবশেষে ব্রিটিশ সৈন্যরা স্যার হিউ রস নেতৃত্বে ঘাঁটি গড়ে বসে। তা এবং ঝাঁসি রাজ্য আক্রমণ করে। রানী লক্ষ্মীবাঈ তার বাহিনী নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ঝাঁসির হয়ে তাতিয়া টোপিও কুড়ি হাজার সৈন্য সম্মানিত একটি দলের নেতৃত্ব দেন যদিও শেষ অবধি তারা প্রশিক্ষিত শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্রিটিশ সৈন্যদের অবরোধ ভাঙতে পারেনি। রানী লক্ষ্মীবাঈ অবশেষে হার স্বীকার করতে বাধ্য হন। ইংরেজ বাহিনী ঝাঁসিতে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বেই লক্ষীবাই তার পুত্রসহ রাজ্য ছেড়ে কল্পিতে পালিয়ে যান। এবং তাতিয়া টোপির নেতৃত্বে একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দেন।
বীরাঙ্গনার নীতি ও সম্মাননা:
ভারতে অনেক স্থানে লক্ষ্মীবাঈ এর মূর্তি দেখা যায় যেখানে রানী ঘোড়ার পিঠে তলোয়ার হাতে পিঠে ছেলেকে বাধা অবস্থায়। লক্ষ্মীবাঈ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন, তিরুবন্তপুরমে লক্ষীবাঈ ন্যাশনাল কলেজ অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন, ঝাঁসিতে রানী লক্ষীবাঈ মেডিকেল কলেজ নাম তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ কেন্দ্রীয় কৃষি বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। রানী ঝাঁসি মেরিন ন্যাশনাল রানী ঝাঁসি মেরি ন্যাশনাল পার্ক টি বঙ্গোপসাগর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। ভারতের জাতীয় সেনা বাহিনীর একটি মহিলা ইউনিটের নাম ছিল ঝাঁসি রেজিমেন্ট রানী। ১৯৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের শতবর্ষ স্মরণে দুটি ডাক টিকিট জারি করা হয়েছিল তার নামে। রানী লক্ষ্মীবাঈ কে নিয়ে রচিত হয়েছে কিছু গান, হিন্দি কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
রানী লক্ষ্মীবাঈ এর মৃত্যু:
মহাবিদ্রোহের আগুন তীব্রভাবে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লে রানী লক্ষ্মীবাঈ ও তাতিয়া টোপি গোয়ালী ওরের দিকে রওনা দেন। সেখানে তাদের যৌথ বাহিনী গোয়ালিরের মহারাজের দলকে পরাজিত করে এবং পরাজিত বাহিনীর সদস্যরা যৌথ বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়। তারপর কৌশলগত অবস্থানে থাকা গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করেন তাদের সম্মিলিত বাহিনী। ১৭ ই জুন ১৮৫৮ সালের ফুলবাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাই- কি – সেরাইয়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে পূর্ণদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন রানী লক্ষ্মীবাঈ। পরবর্তীতে আরো তিন দিন পর ব্রিটিশ সেনাদল গোয়ালিয়র পূর্ণ দখল করে। যুদ্ধে শেষে ব্রিটিশ জেনারেল হিউ রস এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে “রানী তার সহজাত, সৌন্দর্য, চতুরতা এবং অসাধারণ অধ্যাবসায়ের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও তিনি বিদ্রোহী সকল নেতা-নেত্রী তুলনায় সবচেয়ে বিপদজনক ছিলেন।
উত্তরাধিকার:
লক্ষ্মীবাঈ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অন্যতম নারী। তার সাহস বিরক্ত এবং আত্মত্যাগের গল্প আজও ভারতীয় সমাজে অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে আছে। তিনি নারী শক্তির উদাহরণ হয়ে আছেন আজও ইতিহাসের পাতায়। তার বিরক্তপূর্ণ কাহিনী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতের মুক্তি কামি মানুষের মনে বেঁচে থাকবে। তাই তিনি আমাদের মধ্যে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ হয়ে বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন আজীবন। এবং ইতিহাসের পাতায় এক সাহসী নারী হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে|
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অন্যতম নারী ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে যদি আপনার সাহায্যকারী মনে হয় তাহলে আপনার বন্ধু বান্ধবী ও সহপাঠীদের মধ্যে পোস্টটি শেয়ার করুন। আরো নিত্যনতুন তথ্য পেতে আমাদের এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন চোখ রাখুন এবং আমাদের সাথে থাকুন।
।।ধন্যবাদ।।
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.