যতীন্দ্রমোহন বাগচী জীবনী
Jotindromoho bagchi
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই।
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জলে।
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই।
মাগো আমার ফুলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন।
তোমার থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমি যদি লুকায় গিয়ে।
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই দিদিও নাই কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস মা পুকুর পাড়ে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
দিদি এসে শুনবে যখন বলবি কিনা মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে, ঝিঝি ডাকে ঝোপে ঝাড়ে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না তাইতো জেগে রই।
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
জন্ম ও শৈশব:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি যতীন্দ্রনাথ বাগচীর জন্ম ১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর, নদীয়া জেলার জামশেদপুর গ্রামে। তার পিতার নাম ছিল কালীপ্রসন্ন বাগচী এবং মাতার নাম ছিল রামেশ্বরী দেবী। যতীন্দ্রনাথের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালাতেই শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা:
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই যতীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। কর্মজীবনে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের একটি উচ্চ পদে কাজ করতেন। তবে তাঁর আসল পরিচয় কবি হিসেবে।
সাহিত্যিক কর্মজীবন:
যতীন্দ্রনাথ বাগচী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লঘু’ প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকমহলে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি ও মানব জীবনের নানান দিক সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রধান কাব্যগ্রন্থ ও রচনা:
যতীন্দ্রনাথের প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হল: ‘লঘু’ (১৯০৫), ‘তপোবন’ (১৯০৮), ‘ধূপছায়া’ (১৯১৯), ‘নবাঙ্কুর’ (১৯২৩), ‘অরুণ’ (১৯৩৬) এবং ‘মায়া’ (১৯৩৮)। এসব কাব্যগ্রন্থে প্রেম, প্রকৃতি, মানব জীবন, জাতীয়তাবোধ প্রভৃতি বিষয়গুলি সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় তিনি প্রকৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং প্রেমের প্রতি অপরিসীম আকর্ষণ অনুভব করতেন।
‘লঘু’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতা হল:
১. ‘কোকিল’
২. ‘সন্ধ্যা’
৩. ‘অশ্রুমালা’
৪. ‘নব বসন্ত’
‘তপোবন’ কাব্যগ্রন্থে তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্য এবং শান্তি খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। এখানে তিনি মানবজীবনের নানান সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন প্রকৃতির কোলে।
‘ধূপছায়া’ কাব্যগ্রন্থে তিনি জীবনের মায়া-মমতা এবং মানবজীবনের নানা জটিলতাকে চিত্রিত করেছেন। এখানে তাঁর কাব্যশৈলী অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মর্মস্পর্শী।
প্রেম ও প্রকৃতির কবি:
যতীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি প্রধান স্থান দখল করে আছে। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং প্রেমের অনুভূতি একই সঙ্গে মিশে থাকে। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং তা তাঁর কবিতায় সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন।
প্রেম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গভীর এবং সূক্ষ্ম। তাঁর কবিতায় প্রেমের অনুভূতি এতটাই জীবন্ত যে পাঠক হৃদয়ে সহজেই তা স্থান করে নেয়। প্রেমকে তিনি কখনও প্রকৃতির রূপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন, কখনও বা জীবনের নানান মুহূর্তের সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রিত করেছেন।
সামাজিক ও জাতীয়তাবাদ:
যতীন্দ্রনাথের কবিতায় সামাজিক এবং জাতীয়তাবাদী চেতনারও প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর কবিতায় সমাজের নানা সমস্যা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি মনে করতেন যে, কবিতা সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। তাঁর কবিতায় এ বিষয়গুলি অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে চিত্রিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন:
যতীন্দ্রনাথ বাগচীর ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই সরল এবং সাধারণ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং হৃদয়বান ব্যক্তি। তাঁর জীবনে বহু কষ্ট এবং সংগ্রামের ঘটনা রয়েছে, যা তাঁকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছিল। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরাও তাঁকে সবসময় উৎসাহ ও সাহস যুগিয়েছেন।
মৃত্যু:
জীবনের শেষ বয়সে যতীন্দ্রনাথ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়।
উপসংহার:
যতীন্দ্রনাথ বাগচী বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, মানবজীবনের বিভিন্ন দিক এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর রচনাশৈলী, ভাবপ্রবণতা এবং বিষয়বস্তু পাঠক হৃদয়ে আজও জীবন্ত। যতীন্দ্রনাথ বাগচী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টির জন্য
প্রেম প্রকৃতির কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনার বন্ধু, বান্ধবী, সহপাঠীদের মধ্যে শেয়ার করে দেবেন। আরো নিত্যনতুন তথ্য পেতে আমাদের এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন চোখ রাখুন এবং আমাদের পাশে থাকুন |
।।ধন্যবাদ।।
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.