কার্তিক পূজা : ইতিহাস ও তাৎপর্য
Kartik Puja 2024
কার্তিক পূজা : ভারতীয় পুরাণে কার্তিক বা কার্তিকেয় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। যুদ্ধের দেবতা, দেব সেনাপতি এবং শিব-পার্বতীর পুত্র কার্তিক পৌরাণিক দেবতাদের অন্যতম। তার নাম বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিচিত—মুরুগান, স্কন্দ, শণমুখা, সুব্রাহ্মণ্য ইত্যাদি। তামিলনাড়ু থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত তার পূজা ও জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে রয়েছে।
কার্তিকের জন্মকথা
পুরাণ অনুযায়ী, তারকাসুর নামে এক অসুরকে বধ করার জন্য কার্তিকের জন্ম হয়। শিব ও পার্বতীর তেজ থেকে উৎপন্ন এক অগ্নিপিণ্ড গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হলে তা শরবনে গিয়ে কার্তিকের রূপ নেয়। কৃত্তিকাগণ তাকে লালন-পালন করেন। তাই তার নাম রাখা হয় “ কার্তিক ”।
বৈচিত্র্যময় রূপ ও উপাসনা
কার্তিকের মূর্তি বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। কখনো তাকে ময়ূরের পিঠে আসীন দেখা যায়, কখনো শক্তিশূল হাতে চিত্রিত করা হয়। তার ছয়টি মাথা এবং চিরযৌবনের চেহারা তার জন্মের বিশেষ কিংবদন্তির পরিচায়ক।
উত্তর ভারতে তিনি কুমার বা মহাসেন হিসেবে পূজিত হন। দক্ষিণ ভারতে তিনি “মুরুগান” নামে তামিল সংস্কৃতির অংশ এবং তামিলদের রক্ষাকর্তা বলে বিবেচিত। তামিলনাড়ুর ছয়টি প্রধান মুরুগান মন্দির তার জনপ্রিয়তার কেন্দ্র।
কার্তিক পূজার তাৎপর্য
কার্তিক পূজা ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যে ভরপুর।
- সন্তান কামনা: বলা হয় কার্তিক ঠাকুরের কৃপায় নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ হয়। এই কারণে পূজার সময় অনেক বাড়ির সামনে কার্তিকের মূর্তি স্থাপন করা হয়।
- যুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক: কার্তিক দেবতা শত্রুদের বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই তাকে পূজা করার মাধ্যমে মানুষ তার সাহসিকতা ও শক্তিকে সম্মান জানায়।
- সমাজের একতা: পূজা উপলক্ষে শোভাযাত্রা, গান, নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে মিলনের বার্তা প্রচারিত হয়।
- কৃষিভিত্তিক উৎসব: কার্তিক মাস কৃষির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। নতুন ফসল কাটা ও কৃষিকাজে উন্নতি কামনায় এই পূজা করা হয়।
কার্তিক পূজার সময়কাল (২০২৪):
- কার্তিক পূর্ণিমা শুরু: ১৫ নভেম্বর, সকাল ৬:১৯
- পূর্ণিমা শেষ: ১৬ নভেম্বর, রাত ২:৫৮
- শুভ সময়: ১৬ নভেম্বর, ভোর ৪:৫৫ থেকে ৬:২৪ পর্যন্ত
কার্তিকের ছ’টি মাথার পৌরাণিক কাহিনী
দশমুখ রাবণকে যেমন দশানন বলা হয়, তেমনি কার্তিকের ছয়টি মাথার জন্য তাঁকে ষড়ানন নামে অভিহিত করা হয়। এই ছয়টি মাথার পেছনে রয়েছে এক আশ্চর্যজনক পৌরাণিক কাহিনী।
শিব ও পার্বতীর যোগে উৎপন্ন এক অগ্নিপিণ্ড গঙ্গায় পতিত হয়। গঙ্গার স্রোতে সেই অগ্নিপিণ্ড ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয় এবং ছয়জন কৃত্তিকার গর্ভে প্রতিস্থাপিত হয়। এর ফলেই কার্তিক ছয় মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এই ছয়টি মাথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাত্সর্য—এই রিপুগুলিকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করে।
কার্তিকের বিভিন্ন নাম ও তাঁর চরিত্র
কার্তিকের অনেক নাম রয়েছে, যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, কুমার, গাঙ্গেয়, বিশাখ, নৈগমেয়, এবং কুক্কুটধ্বজ। কোথাও তাঁকে চিরকুমার বলা হলেও, অনেক পৌরাণিক কাহিনিতে দেখা যায় তাঁর দুই স্ত্রী ছিলেন—দেবসেনা এবং বল্লী।
- বাহন: ময়ূর
- অস্ত্র: বর্ষা, তীর-ধনুক
- শক্তি: দেবতাদের সেনাপতি ও যুদ্ধকুশল বীর যোদ্ধা
কার্তিক পূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
১. পুত্র সন্তানের আশায় পূজা: বাংলার অনেক পরিবারে, বিশেষ করে নবদম্পতিদের বাড়িতে কার্তিক ঠাকুর স্থাপনের রীতি রয়েছে। কারণ কার্তিককে আরাধনা করলে সন্তান লাভ হয় বলে প্রচলিত বিশ্বাস।
২. বাঙালির উৎসবের আবেগ: হুগলি জেলার চুঁচুড়া, বাঁশবেড়িয়া, এবং কাটোয়ার কার্তিক পূজা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। কাটোয়ায় এই পুজো কেন্দ্র করে মিছিল এবং প্রতিযোগিতার চল রয়েছে, যাকে “কার্তিক লড়াই” বলা হয়।
৩. দক্ষিণ ভারতের মুরুগান পূজা: তামিলনাড়ুতে কার্তিক মুরুগান নামে পূজিত হন। তিনি তামিল সম্প্রদায়ের রক্ষাকর্তা এবং বিশেষ উৎসবের মাধ্যমে আরাধিত।
৪. কুমার পূজা: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্তিক কুমার বা স্কন্দ নামে পূজিত হন। হিমাচলপ্রদেশ এবং ওড়িশাতেও এই পূজা প্রচলিত।
কার্তিক পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিথ ও কাহিনী
কার্তিক পূজার প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী:
- দেবসেনা ও ষষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক: কার্তিকের স্ত্রী দেবসেনা এবং ষষ্ঠী দেবী সন্তানলাভের আশায় পূজিত হন।
- কুমারত্ব ও সন্তান উৎপাদনের প্রতীকীতা: কার্তিককে অনেক সময় চিরকুমার মনে করা হলেও, তাঁকে সন্তানলাভ ও উর্বরতার দেবতা হিসেবেও আরাধনা করা হয়।
- গণিকা সমাজের পূজা: বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা এককালে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল।
বিশেষ উৎসব স্থান ও ঐতিহ্য
- পাল বাড়ির ঐতিহাসিক তিন কার্তিক: বর্ধমান জেলার গৌরবাজার গ্রামে পাল পরিবার তিনটি পৃথক কার্তিক ঠাকুরের পুজো করেন। এই পুজোর সূচনা ১৮৫৩ সালে এবং এটি আজও পাল পরিবারের উত্তরাধিকারীরা পালন করে আসছেন।
- তামিলনাড়ুর ছয় মন্দির:
- স্বামীমালাই মুরুগান মন্দির
- পালানী মুরুগান মন্দির
- থিরুচেন্দুর মুরুগান মন্দির
- থিরুপ্পারামকুমারাম মুরুগান মন্দির
- থিরুথানি মুরুগান মন্দির
- পাঝামুদিরচোলাই মুরুগান মন্দির
পশ্চিমবঙ্গের কার্তিক পূজা
পশ্চিমবঙ্গে কার্তিক পূজা তার বিশেষ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত।
- গণিকা সমাজের পূজা: বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিশ্বাস, এই পূজা তাদের সৌভাগ্য এবং সন্তানের আশীর্বাদ নিয়ে আসে।
- কাটোয়ার কার্তিক লড়াই: কাটোয়ার কার্তিক পূজা ও শোভাযাত্রা এক ঐতিহ্য। প্রতিদ্বন্দ্বী পূজামণ্ডপগুলো তাদের ঠাকুর নিয়ে মিছিল করে। এই লড়াইয়ে অস্ত্রের ব্যবহার এবং কৌশল প্রদর্শন চোখে পড়ে।
- পাল বাড়ির ঐতিহাসিক পূজা: বর্ধমানের গৌরবাজারে পাল জমিদারদের কার্তিক পূজা আজও ঐতিহ্যের সাক্ষী। তাদের তিনটি মূর্তি—বড়, মেজো এবং ছোট কার্তিকের একসঙ্গে পূজা করার ইতিহাস অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য
কার্তিক পূজা সন্তান কামনার পূজা হিসেবেও পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, তিনি সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তানের আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়াও, এই পূজা মানুষের মধ্যে সাহস, যুদ্ধজয় এবং সাফল্যের অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে।
দক্ষিণ ভারতের তামিল সম্প্রদায় কার্তিক বা মুরুগানকে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রবাসী তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তার পূজা বিশেষ গুরুত্ব পায়।
কার্তিক পূজার বর্তমান অবস্থা
আজকের দিনে, কার্তিক পূজা একদিকে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং অন্যদিকে সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। যদিও গ্রামীণ এবং শহুরে অঞ্চলে পূজার ধরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, তবু তার জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছে।
উপসংহার
কার্তিক পূজা আমাদের সংস্কৃতির এক অনন্য দিক, যা ধর্মীয় আচার, ঐতিহ্য এবং সামাজিক একতার প্রতীক। এই পূজার মাধ্যমে বাঙালি সমাজ সাহস, ত্যাগ, এবং ঐক্যের বাণী প্রচার করে।
(Biswarup Santra)
mystate.co.in
for more clik bellow
কার্তিক পূজা 2023 তারিখ ও সময় | Kartik Puja 2023 Date & Muhurat
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.