প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জীবনী
Pritilata Waddedar
ভূমিকা:
আদর্শবোধ ও মধ্য দিয়ে যারা নিজেদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বিশ শতকে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী বাংলা নারী সমাজ প্রথম দিকে পরোক্ষভাবে অংশ নিতে শুরু করেন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ অত্যাচার, গ্রেফতার, নির্বাসন প্রকৃতির নির্যাতন বাড়তে থাকলেও নারীদের আন্দোলন থেমে থাকেনি। আদর্শ বোধ ও আত্ম বলিদান এর মাধ্যমে যারা নিজেদের জীবনকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ই মে চট্টগ্রামের পাটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পৌরসভার হেড কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভা দেবী। তার ছয় সন্তান হল- মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনক লতা, আশালতা, সন্তোষ ও তাদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত পরিবারের অন্য এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ‘ ওয়াহেদ্দার’ উপাধি পেয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল ড: খাস্তাগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। শৈশব থেকেই তিনি খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। সেই কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী ও ছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালে তিনি বিদ্যালয়ের পার্ট শেষ করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। সাহিত্য চর্চায় তিনি খুব উৎসাহ ছিলেন। কলেজের পরীক্ষার তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কেবল পড়াশোনায় নয়, তিনি সামাজিক কাজকর্মে এর প্রতিও উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় আছেন এবং বেথুন কলেজে ভর্তি হন। দুই বছর পর দর্শন স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি পাস করেন। যদিও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও প্রীতিলতা ও তার সঙ্গী বীণা দাশগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। বর্তমান সময়ে ২২শে মার্চ ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে মরনোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে তাদের দুজন কলেজে পড়া শেষ করে চট্টগ্রামে তিনি আবার ফিরে আসেন।
কর্মজীবন:
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর এর কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় বিদ্যালয় ‘নন্দনকানন অপর্ণাচরণ’ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে।
বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ:
বীর কন্যার এক নিকট আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তি দ্বার ছিলেন বিপ্লবী দলের কর্মী। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই তিনি বোন প্রীতিলতার কাছে রেখে দেন। তিনি মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তিনি লুকিয়ে বইগুলি পড়তেন। দেশের কথা, বাঘাযতীন, কানাইলাল, বাজেয়াপ্ত করার এই সমস্ত গ্রন্থ প্রীতিলতা বিপ্লবী আদর্শের অনুপ্রাণিত করেছিল।
স্বদেশী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা:
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। তার আত্ম বলিদান তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সাহসিকতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। তার মৃত্যুর পর আরো অনেক যুবক-যুবতী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেন, এবং তার অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে।
দিপালীর সংঘ:
লীলা নাগের নেতৃত্বে ‘দিপালী সংঘ’ নামে একটি সংগঠন করে তোলেন। নারী শিক্ষা প্রসারে জন্য তিনি কাজ করতেন। ঢাকায় অবস্থিত এই সংঘ মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করত। দিপালী সংঘের যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠি খেলা, ছরাখেলা ইত্যাদি খেলার অংশগ্রহণ করেছিল।
বিপ্লবী দলে যোগদান:
প্রীতিলতা তার দাদা পূর্ণেন্দু দস্তি দ্বার কাছে বিপ্লবী সংগঠন গুলিতে যোগদান করা নিবিড় ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি তখন পর্যন্ত বিপ্লবী সংগঠনের কোন মহিলা যোগদান করেনি। কিন্তু প্রীতিলতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের অটল সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৩ ই জুন ১৯৩২ সালে ধলঘাট ক্যাম্পে সূর্যসেন এবং নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করেন। বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাদের দলে মহিলা যোগদানের ক্ষেত্রে আপত্তি করলেও অবশেষে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কারণ বিপ্লবীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে অস্ত্র পরিবহনকারী মহিলারা পুরুষদের মতো এতটা সন্দেহ ভাজন হবে না।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড:
সূর্য সেন এবং তার বিপ্লবী দল চট্টগ্রামের মহাপরিদর্শক ক্রেগকে হত্যার দায়িত্ব নেন। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালিপদ চক্রবর্তীকে। কিন্তু তারা ভুল করে চাঁদপুরের এসপি এবং তরনি মুখার্জিকে হত্যা করে। সেই সেই রাতেই রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করে আলিপুর জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় প্রীতিলতা কলকাতা থাকায় রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রীতিলতা বোন হিসাবে পরিচয় দিয়ে ৪০ বার রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন। এরপরের সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সাথে প্রীতিলতা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসে আক্রমণ এবং রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখলের মতো অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছিলে। এবং জালালবাদ যুদ্ধে বিপ্লবীদের বিস্ফোরক সরবাহের দায়িত্ব নেন।
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ:
১৯৩২ সালে সূর্যসেন পাহাড়িতলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই ক্লাবের সামনে সাইনবোর্ড লেখা থাকতো’ ড্গস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান নট অ্যালাওড ‘। দেশের মানুষের সঙ্গে সাহেবরা যে দুর্ব্যবহার করে তার উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য মাস্টারদা নির্দেশে প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন স্থির হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে সেপ্টেম্বর আক্রমণের আগে সাত দিন আগে কল্পনা দত্তকে গ্রেফতার করা হয়। প্রীতিলতা তখনও অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য কতোয়ালী সমুদ্র তীরে যান। এবং সেখানে তাদের আক্রমণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন। গ্রুপের সদস্যদের পটাশিয়াম সাইনাইটেট দেয়া হয়েছিল। এবং ধরা পড়লে তা গিলে ফেলতে বলা হয়েছিল। অবশেষে সেই দিন প্রীতিলতা পাঞ্জাবি সাথে মাথায় পাগড়ি বেঁধে পুরুষের পোশাক পড়ে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন তার সহযোগী কালিশংকর কালি শংকর দে, বীরেশ্বর রায়, ধুতি ও শার্ট পড়েন। এবং পান্না সেন লুঙ্গি ও শার্ট পড়েছিলেন। রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তারা ক্লাবে পৌঁছে আক্রমণ চালায়। তখন ক্লাবের ভিতরে ৪০ জন লোক ছিল। আক্রমণের জন্য বিপ্লবীরা নিজেদের তিনটি পৃথক জলে বিভক্ত করেছিলেন। তারা গুলি শুরু করার পূর্বেই ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্লাবে উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ অফিসারের হাতে রিভলবার ছিল এবং তারা সাথে সাথে সেখানে গুলি ছুটতে শুরু করে। প্রীতিলতা একটি বুলেট এ আহত হন পুলিশ রিপোর্ট অনুসারে এই হামলায় একজন মহিলা মারা যান এবং চারজন পুরুষ ও সাতজন মহিলা আহত হন। গুলিবদ্ধ হয়ে প্রীতিলতা ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারি এরাতে পটাশিয়াম সাইনাইটেড গিলে নেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৫ শে সেপ্টেম্বর পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। মৃতদেহ তল্লাশি করে পুলিশ কিছু লিফলেট, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি, গুলি, বাঁশি এবং পরিকল্পনার খসড়া পায়। ময়নাতদন্তের দেখা যায় প্রীতিলতা বুলেটের আঘাতে নয়, বরং পটাশিয়াম সাইনাইটেড এর বিষক্রিয়ায় তিনি মারা যান।
উপসংহার:
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ইতিহাসের বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আজও তিনি আমাদের মধ্যে জীবিত আছেন। তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে। এবং তিনি বিপ্লবী বাঙালি নারী হিসেবে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রীতিলতা স্বাধীনতার জন্য অসীম ত্যাগ, দেশপ্রেম ও আদর্শ আজও মানুষ স্মরণ করে।
একজন বিপ্লবী ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যদি জীবনীটি ভালো লেগে থাকে যদি আপনার সাহায্যকারী মনে হয়। তাহলে আপনার বন্ধু, বান্ধবী ও সহপাঠীদের মধ্যে শেয়ার করে দেবেন। আরো নিত্যনতুন তথ্য পেতে আমাদের এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন চোখ রাখুন এবং আমাদের পাশে থাকুন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মতো বিপ্লবী বীর কন্যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধা আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন আজীবন।
।।ধন্যবাদ।।
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.