রাধাগোবিন্দ করRadha Gobinda Kar (Bengali: রাধাগোবিন্দ কর; 23 August 1852 – 19 December 1918)

রাধাগোবিন্দ কর

Radha Gobinda Kar ( R. G. KAR )

রাধাগোবিন্দ কর (২৩ আগস্ট ১৮৫২ – ১৯ ডিসেম্বর ১৯১৮) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় চিকিৎসক এবং সমাজসেবী। তাঁর নামাঙ্কিত আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত।

পরিবার এবং শৈশব

রাধাগোবিন্দ করের জন্ম ২৩ আগস্ট ১৮৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের সাঁতরাগাছিতে। তাঁর পিতা দুর্গাদাস করও একজন চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর পরিবার ছিল ধনী এবং শিক্ষিত, যা রাধাগোবিন্দের শিক্ষাজীবন এবং পেশাগত জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।

শিক্ষা জীবন

রাধাগোবিন্দ প্রথমে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই কলেজ ছেড়ে দেন। পরে ১৮৮০ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং তিন বছর সেখানে পড়াশোনা করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম

পড়াশোনা শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে প্রাথমিকভাবে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর প্র্যাকটিস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আসতে শুরু করেন।

রাধাগোবিন্দের সহপাঠীরা ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, যা তাঁকে বাংলা ভাষায় চিকিৎসা বই অনুবাদ এবং লেখার অনুপ্রেরণা দেয়। তাঁর প্রথম বই ‘ভীষবন্দু’ ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন, যেমন ‘সংক্ষিপ্ত শারীরবিদ্যা’, ‘রোগী পরিচর্যা’, ‘বিশাখা সুহৃদ’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগ চিত্রকলা এবং সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব’, ‘শিশু এবং বাল্যকালীন চিকিৎসা’, এবং ‘সংক্ষিপ্ত শারীরবিদ্যা’।

কলকাতা মেডিক্যাল স্কুলের প্রতিষ্ঠা

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে রাধাগোবিন্দ কর তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং রোগীদের সাথে একত্রিত হয়ে কলকাতায় একটি আধুনিক চিকিৎসা স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। তবে, এটি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ছিল অর্থ এবং জমি, যা তাঁর মতো সীমিত সম্পদের ব্যক্তির পক্ষে সংগ্রহ করা কঠিন ছিল।

তাই, তিনি বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অতিথিদের সাথে কথা বলে তাঁদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তাঁর অনড় সংকল্প দেখে কিছু চিকিৎসক বন্ধু তাঁর সাথে যোগ দেন। এই প্রচেষ্টার ফলে, ১৮৮৬ সালের ১৮ অক্টোবর রাধাগোবিন্দ কর, ডাঃ মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ অক্ষয় কুমার দত্ত, ডাঃ বিপিন বিহারী মৈত্র, ডাঃ এম. এল. ডি, ডাঃ বি. জি. বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডাঃ কুন্ডা ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য চিকিৎসকরা মিলে কলকাতা স্কুল অব মেডিসিন প্রতিষ্ঠা করেন।

আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের ইতিহাস

আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পুরনো এবং সম্মানিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে রাধাগোবিন্দ করের অবিস্মরণীয় প্রচেষ্টা এবং সংকল্পের গল্প।

প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা

১৯শ শতকের শেষ দিকে কলকাতা ছিল বিভিন্ন রোগের কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু শহরে পর্যাপ্ত হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সেবার অভাব ছিল। রাধাগোবিন্দ কর, যিনি নিজে একজন চিকিৎসক ছিলেন, এই অভাব উপলব্ধি করে কলকাতায় একটি আধুনিক এবং মানসম্মত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

সংগ্রামের শুরু

রাধাগোবিন্দ করের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমে জমি কেনা এবং হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন সীমিত সম্পদের একজন মানুষ, তাই তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিনি সহজে হাল ছাড়েননি।

রাধাগোবিন্দ কর বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে ধনী অতিথিদের সাথে কথা বলে তাঁর পরিকল্পনা শেয়ার করতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য চেয়ে নিতেন। এভাবেই তিনি প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তাঁর এই অদম্য প্রচেষ্টা দেখে তাঁর কিছু চিকিৎসক বন্ধু যেমন ডাঃ মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ তাঁকে সমর্থন করেন এবং তাঁরা সবাই মিলে এই উদ্যোগে অংশ নেন।

কলকাতা স্কুল অব মেডিসিনের জন্ম

অবশেষে, ১৮৮৬ সালের ১৮ অক্টোবর রাধাগোবিন্দ কর এবং তাঁর সহযোগীরা “কলকাতা স্কুল অব মেডিসিন” প্রতিষ্ঠা করেন। এটি এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছিল। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবমুক্ত একটি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলা, যেখানে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষা পাবে।

নাম পরিবর্তন এবং উন্নয়ন

১৮৮৭ সালে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করে “কলকাতা মেডিক্যাল স্কুল” রাখা হয়। ১৯০৪ সালে এটি বেঙ্গল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স এবং সার্জনসের সাথে একীভূত হয় এবং নাম পরিবর্তন করে “দ্য কলকাতা মেডিক্যাল স্কুল এবং কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স এবং সার্জনস অফ বেঙ্গল” রাখা হয়।

১৯১৬ সালে, এটি “বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ” নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু রাধাগোবিন্দ করের মৃত্যুর পর, ১৯১৮ সালে কলেজটির নাম তাঁর স্মরণে “আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল” রাখা হয়।

আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান অবস্থা

আজকের দিনে, আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল একটি অত্যাধুনিক মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত। এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। কলেজটি আজও বহু ছাত্রছাত্রীকে মানসম্পন্ন চিকিৎসা শিক্ষা প্রদান করছে এবং রাধাগোবিন্দ করের স্বপ্নের প্রতিফলন হিসেবে বেঁচে আছে।

রাধাগোবিন্দ করের অবদান এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজটি আজও অনেকের জীবন রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content