সতীনাথ ভাদুড়ীর জীবনী
Biography of Satinath Bhaduri
“- সামনে বাত্তি দেখাও’- কতকগুলি বিকৃতাঙ্গ প্রেতের ছায়া ক্রমে ছোট হইয়া লণ্ঠনের আলোকে মিলাইয়া যায়। লণ্ঠনগুলি এই দিকে আগাইয়া আসিতেছে- সহস্র গ্রহ-উপগ্রহ কক্ষচ্যুত হইয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। প্রতি লোমকূপে প্রত্যাশিত আতঙ্কের সাড়া- প্রতি স্নায়ুতে টাইফুনের বিক্ষোভ- এই আলোড়ন অক্ষিগোলকের মধ্যে দিয়া ফুটিয়া বাহির হইতে চায়।- তুমুল ব্যাতাবিক্ষোভে আর বুঝি দাঁড়াইতে পারা যায় না।… দৃঢ় মুষ্টিতে গরাদ চাপিয়া ধরিয়াছি।”
― জাগরী
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
১৯০৬ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর(১১ আশ্বিন, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার) বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যায় অধুনা বিহার রাজ্যের অন্তর্গত ভোট্টা বাজারে সতীনাথ ভাদুড়ী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী (১৭৬৯-১৯৪৪) ও রাজবালা দেবীর ষষ্ঠ সন্তান। সতীনাথ ভাদুড়িরা ছিলেন তিন ভাই পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সতীনাথ তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভূতনাথ ভাদুড়ীর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন।তিনি তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম চিত্র গুপ্ত দ্বারা ব্যাপক পরিচিত ছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
সতীনাথ ভাদুড়ীর বিদ্যালয়ের শিক্ষার সূত্রপাত শুরু হয় পূর্ণিয়া জেলার স্কুলে। ১৯২৪ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, তিনি পার্টনার সাইন্স কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এবং ১৯২৮ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। ওই বছরেই সতীনাথ ভাদুড়ীর মা রাজবালা দেবীর মৃত্যু ঘটে। এরপর ১৯৩০ সালে সতীনাথ ভাদুড়ি অর্থনীতিতে স্নাতকোওর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরের বছরে পাটনা কলেজ থেকে বি এল পাশ করেন।
কর্ম ও সাহিত্য জীবন:
১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সতীনাথ ভাদুড়ী বাবার সহকর্মী পূর্ণিয়া আদালতে ওকালতি করতেন। এই সময় তিনি বলি প্রথা রদ ও মদের দোকানের পিকেটিং আন্দোলনের মতে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজের জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বই সংগ্রহ করে পূর্ণিয়া গ্রন্থাকার স্থাপনের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন সতীনাথ ভাদুড়ী। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থাগার টির নাম সতীনাথের পিতার নাম অনুসারে রাখা হয় ইন্দুভূষণ সাধারণ গ্রন্থাগার। প্রায় একই উদ্যোগে তিনি পূর্ণিয়ায় বাংলা পত্রিকা ক্লাব গঠন করেন এবং সাহিত্য পাঠ, স্মরণশক্তি প্রতিযোগিতা, সাহিত্যিকদের আড্ডা প্রবৃত্তির প্রচলন ঘটান। এই সূত্রই তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সক্রিয়ভাবে অসহযোগ আন্দোলনের যোগদান করেন। এই সময় পুলিশের চোখ এড়িয়ে গভীর রাতে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে জিনিস স্বাধীনতা আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিতেন। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম বারের জন্য কারারুদ্ধ হন সতীনাথ ভাদুড়ী। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় দ্বিতীয়বার কারাবাসকালে তিনি জেল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাই তাকে ভাগলপুরের সেন্ট্রাল জেলের স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময়টি ছিল তার বিখ্যাত উপন্যাস জাগরী রচনার প্রস্তুতিকাল। ১৯৪৪ সালে তৃতীয়বার কারাবাসী তার সঙ্গী ছিলেন খনিস্বর নাথ ১৯৪৪ সালে তৃতীয়বার কারাবাসী তার সঙ্গী ছিলেন ফনীশ্বরনাথ রেনু, অনাথবন্ধু বসু, ফনীগোপাল সেন, জয়প্রকাশ নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, অনুগ্রহ নারায়ণ প্রমুখেরা এরপর ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় জাগরী।
সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিতও:
- পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার বিখ্যাত রচনা “শাসিত রাজনীতি”কে “ভারতের ঔপনিবেশিক শাসন এবং জাতীয় আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্য যৌক্তিকতার প্রতিফলন” হিসাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
- তার ছোট গল্পগুলি প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতি এবং নারীবাদী সমস্যাগুলির সমালোচনা করে।
- সতীনাথের ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনাগুলিকে প্রচলিত সাহিত্য বা সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টান্তের মধ্যে শ্রেণীবদ্ধ করাকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
কংগ্রেস পার্টি ত্যাগ:
স্বাধীন আন্দোলনের সময় তিনি কংগ্রেসের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন, কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মের অতিষ্ট হয়ে ১৯৪৭ সালের কংগ্রেস ত্যাগ করে সমাজতন্ত্রী দলে যোগ দেন। এক পুরনো গ্রামীণ পার্টি কর্মীর কাছে কংগ্রেস ছাড়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে কংগ্রেসের কাজ ছিল স্বাধীনতা অর্জন করা।, সেই কাজ সম্পূর্ণ এখন রাজকার্য ছাড়া আর কংগ্রেসের কোন কাজ নেই।
রচনাবলী:
•জাগরী(১৯৪৫), চিত্রগুপ্তের ফাইল (১৯৪৯), •ঢোঁড়াই চরিত মানুষ (প্রথম চরণ)১৯৪৯, •ঢোঁড়াই চরিত মানুষ (দ্বিতীয় চরণ) ১৯৫১, • গণনায়ক ১৯৪৮, • অপরিচিতা ১৯৫৪, • পত্রলেখার বাবা ১৯৫৯, • আলোক দৃষ্টি (১৯৬৪), • ডাকাতের মা •
সম্মান ও শেষ জীবন:
কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর সতীনাথ পূর্ণিয়ার কিশোর আর তরুণদের জন্য ব্যায়ামাগর গঠন ও শনিবারের সাহিত্য বাসর পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৪৯ সালে তিনি বিদেশে যাত্রা করেন। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে তিনি তার গ্রন্থ জাগরীর জন্য বাংলা ভাষা প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ পান ১৯৫০ সালে। বিখ্যাত সাহিত্যিক ফনীশ্বরনাথ রেনু তার জীবনীমূলক স্মৃতিকথাসতীনাথ ভাদুড়ী রচনা করেন|
মহাপ্রয়াণ:
১৯৬৫ সালে ৩০ শে মার্চ সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রয়াণ ঘটে। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পূর্ণিয়াতে সতীনাথ ভাদুড়ীর মৃত্যু ঘটে|
সতীনাথ ভাদুড়ীর জীবন ও কাজ বাংলা সাহিত্য ও রাজনীতিতে তাঁর বহুমুখী অবদানের প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর উপন্যাসগুলি তাঁর সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে প্রতিফলিত করে সমালোচনামূলক আলোচনাকে অনুপ্রাণিত করে |
Discover more from My State
Subscribe to get the latest posts sent to your email.