সুকুমার রায়সুকুমার রায়

সুকুমার রায়ের জীবনী

Sukumar Roy


বাংলা সাহিত্যে কিছু ও কিশোর সাহিত্যিক বলতেই স্বতঃই এই মনে পড়ে সুকুমার রায়ের নাম। শুধু কি তিনি শিশুমনের শিল্পী? তার অবিমিশ্র  হাস্যরসের সমগ্র বাংলা সাহিত্য অভিষিক্ত, সঞ্জীবিত। তার সৃষ্টি ভাব সমাবেশের অভাবনীয় সংলগ্নতা চমৎকৃতি আনে। তার হাস্যরসের জোয়ারে সমভাবে আবলবৃদ্ধ হাবুডুবু খায়। তার সক্রিয় ও উৎকৃষ্ট ব্যঙ্গ রসিকতা  বাংলা সাহিত্যের একটা গৌরবের আসন্ন  সুপ্রতিষ্ঠিত করে

সুকুমার রায়ের কবিতা ও লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের যেভাবে  তিনি হাস্যরসে ভরিয়ে তুলেছেন। তাই ওনাকে  সম্মান জানিয়ে জীবনে এর কিছুটা অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। 

 

ভাল ছেলের নালিশ

মাগো!

প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা

গুড় মাখিয়ে আরাম ক’রে বসে –

আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,

দুইখানা সেই আপনি খেল ক’ষে!

তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে

কিল মেরেছি ‘হ্যাংলা ছেলে’ বলে-

অম্‌‌নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে

গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!

মাগো!

এম্‌‌নিধারা শয়তানি তার, খেলতে গেলাম দুপুরে,

বল্‌ল, ‘এখন খেলতে আমার মানা’-

ঘন্টাখানেক পরেই দেখি দিব্যি ছাতের উপরে

ওড়াচ্ছে তার সবুজ ঘুড়ি খানা।

তাইতে আমি দৌড়ে গিয়ে ঢিল মেরে আর খুঁচিয়ে

ঘুড়ির পেটে দিলাম করে ফুটো-

আবার দেখ বুক ফুলিয়ে সটান মাথা উঁচিয়ে

আনছে কিনে নতুন ঘুড়ি দুটো !

জন্ম ও পরিবার: 

১৮৮৭  খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বেহালা অঞ্চলে  ৩০ শে অক্টোবর, সুকুমার রায়ের কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম হয় সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন। সুকুমার রায়ের পিতার নাম ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এবং মায়ের নাম ছিল বিধুমুখী দেবী। বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুকুমার রায়ের জন্মেছিল বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্য অনুরাগী, যা তার মধ্যে কার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশের সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয় -বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী।

শিক্ষাজীবন: 

কলকাতা সিটি স্কুল থেকে ইন্টার পাশ করার পর। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বি. এস. সি (অনার্স) করারপর  সুকুমার মুদ্রবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখান থেকে তিনি অলোকচিত্র  মুদ্রন প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন। এবং কালক্রমে তিনি ভারতে অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালের সুকুমার রায় কলকাতাতে ফিরে আসেন। পরে ইংল্যান্ডে পড়া কালীন উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম  একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা ‘ সন্দেশ’ এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমার রায় বিলেত থেকে ফেরা সময় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোর এর মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখা সংখ্যা থাকলেও

কর্মজীবন: 

সুকুমার রায় ছিলেন একজন বহুমুখী লেখক ও শিল্পী যিনি বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর একজন শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু শীঘ্রই পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে লেখালেখিতে পরিণত হয়। সুকুমার রায়ের লেখাগুলি বাচ্চাদের হাস্যরস, বুদ্ধি এবং ব্যঙ্গ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং তিনি তার অর্থহীন কবিতা এবং নাটকের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। রচনারগুলির মধ্যে রয়েছে আবোল তাবোল হ যা বা রা লা কবিতা সংকলন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখান থেকেই তার আবোল তাবোল ছড়া চর্চা শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন সুকুমার রায়। মানডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশ সদস্যরা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সব বিষয়ে আলোচনা করতেন সুকুমার রায় সেইগুলি মজার ছড়া রাখারে একটি সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন। সেগুলির বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিত অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন,  সুকুমার রায়ের লেখকচিত্রী প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মিলে নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরির আর ইংল্যান্ডে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত তার প্রযুক্তি বিষয়ক রচনা গুলো থেকে।

সংস্কৃতিক সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রহ্ম সমাজের সংস্কার পন্থী গোষ্ঠীর এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্মসমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী অদ্বৈত বিশ্বাসী হিন্দু ধর্মে এক শাখা যারা সপ্তম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরাণ ঈষ উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় অতীতের কথা নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন যা বঙ্গ সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে-ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের মতাদর্শের উপস্থাপনা করার লক্ষ্যে এই কবিতাটি একটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি এই সময়ের সব থেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার ব্রাহ্মসমাজ এর সভাপতি কে প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা  সুকুমার রায় করেছিলেন।

মহাপ্রয়াণ :

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কালাজরে লেইশ্মানিয়াসিস আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন সেই সময় এই রোগের কোন চিকিৎসা ছিল না।

উপসংহার: 

মানডে সাহিত্য ক্লাবের মধ্যমণি ননসেন্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠা ব্যঙ্গ রসিক সুকুমার রায়। বিধি নিষেধ তার উপদেশের বাইরে শিশু মনের খোরাক যুগিয়ে সুকুমার রায় শিশুদের অতি আদরের প্রিয় লেখক। তার সেই অনুকরণীয় ব্যঙ্গ রসের যুগ যুগ ধরে পাঠক সঞ্জীবিত ও উজ্জীবিত। বাংলা রস রচনায় তার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত শিশু মনের হদিস সন্ধানী সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের অনুকরণে সাহিত্যের কলরব বাড়াতে নিয়োজিত। এই ব্যর্থ অনুকরণ এর মধ্যে দিয়ে হয়তো সুকুমার রায় আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন।

সুকুমার রায়ের লেখা ও হাস্যরসের মধ্য দিয়ে  তিনি আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবে আজীবন।

 

 


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content