স্বর্ণকুমারী দেবীস্বর্ণকুমারী দেবী

স্বর্ণকুমারী দেবীর জীবনী 


বড়লোক যদি তুমি হতে চাও ভাই,

ভালো ছেলে তাহ’লে আগে হওয়া চাই

মন দিয়ে পড় লেখো

সুজন হইতে শেখ,

খেলার সময় রেখ, তাতে ক্ষতি নাই।

পিতা মাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি।

ভাইটি করছে দ্বন্দ্ব

বোনটি বলছে মন্দ

ক্রোধে হয়ো নাকো অন্ধ, স্নেহ ধর পানি।

প্রতিবাদী দাসদাসী আত্মীয়-স্বজন

ভালবাসি সবে কহ সুমষ্টি বচন

দিও না কাহারে দুঃখ,

নিজেরে মানোগো সুখী, বালক সুজন।

জগতের সৃষ্টিকর্তা যিনি ভগবান,

 যাঁহা হইতে পাইয়াছ সু-খ শান্তি প্রাণ,

 তাঁর কাছে সঁপি  মন,

তাঁরে স্মরি অনুক্ষণ

মা গিয়া মঙ্গল তার কর নাম- গান।

উনিশ শতকে শেষের দিকে বাংলা সাহিত্যে যে সকল প্রতিভাময়ী লেখিকার আবির্ভাব হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম নক্ষত্র স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহিলা ও উপন্যাসিক

আজকে স্বর্ণকুমারী দেবী জীবনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: 

স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৫৫ সালের ২৮শে আগস্ট কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারকনাথ ঠাকুরের পৈত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন। মায়ের নাম ছিল সারদা দেবী

শিক্ষাজীবন: 

স্বর্ণকুমারী দেবীর বিদ্যা শিক্ষা শুরু হয় অন্তঃপুরে তিন বছর বয়স থেকে। তাঁর স্মৃতিকথা  থেকে জানা যায় , তাদের শিক্ষায়ত্রী শ্লেটে লিখে দিতেন, এবং সেখান থেকে তারা লিখতেন। পরবর্তীতে তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অযোধ্যানাথ পাকড়শি নামে এক দক্ষ শিক্ষক কে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে স্বর্ণকুমারী দেবী নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান,  সমাজ, প্রভৃতি বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অসামান্য।

বিবাহিত জীবন:

তিনি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই নভেম্বর নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীকালের জানো কিনা ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে ‘রাজা উপাধি অর্জন করেন’। তিনি ছিলেন একজন দিব্য জ্ঞানবাদী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠা সদস্য।

সাহিত্যিক জীবন: 

সাহিত্যের বহু সাক্ষাতে স্বর্ণকুমারী দেবীর ছিলো সাত ছন্দ পদচারন। সংগীত, নাটক ও সাহিত্য ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যের  সৃষ্টিশীলতা তাকে স্পর্শ করেছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী একাধিক উপন্যাস নাটক, কবিতা ,ও বিজ্ঞানও বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান -পরিভাষা রচনার বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন। বিয়ের আগে থেকেই তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে তিনি পুনরায় সাহিত্য চর্চায় ব্রতী হন। তার নিজস্ব জীবন নিয়ে বিকাশের স্বামীর সহায়তার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:

“আমার প্রিয়তম স্বামীর সাহায্যে ও উৎসাহ ব্যতিরেকে আমার পক্ষে এত দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হইতো না আজ বহির্জগত আমাকে যেভাবে দেখিতে পাইতেছে তিনি আমাকে সেই ভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। এবং তাহার প্রেম পূর্ণ উপদেশ বা ঝটিকা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেমন সন্তরণ নিপুন ব্যক্তি সহজে অবলীললাক্রমে সন্তরণ করিয়া যায়, সাহিত্য জীবনের ঝটিকা ময় ও উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে দিয়া আমি সেই রূপ অবলীলাক্রমে চালিয়া আসিয়াছি।

যদিও তিনি উপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত তবুও নাটক, প্রহসন, গীতিকবিতা, গান প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তার অসামান্য প্রতিভার পরিচয় মেলে।

স্বর্ণকুমারী দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী

রাজনৈতিক জীবন: 

রাজনীতির আঙিনায় স্বর্ণকুমারী দেবীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। তার স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী নিজেকে শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, ভারতের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস ছিল তার। ১৮৯৮ ও ১৮৯০ সালের পন্ডিত রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

সখিসমিতি:

১৯ তম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আবার মাদাম ব্লাভটস্কির দল ভঙ্গের পরে “সখি সমিতি”নামের স্বর্ণকুমারী দেবী মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। সখিসমিতি স্থাপিত হয়েছিল ১৯২৩ সালের বৈশাখ মাসে।

সখি সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল-

‘ মেয়েতে মেয়েতে আলাপ পরিচয়, দেখাশোনা, মেলামেশা স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার ও উন্নতির চেষ্টা, বিধবা রমনীকে সাহায্য করা। অনাথকে আশ্রয় দা ইত্যাদি।

রচনাবলী: 

স্বর্ণকুমারী দেবী বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

উপন্যাস:

দ্বীপনির্মাণ (১৮৭৬), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), ফুলের মালা (১৮৯৫),

গল্পগ্রন্থ:

নব কাহিনী (১৮৯২), গল্পস্বল্প (১৮৯৩)

নাটক প্রহসন:

বসন্ত উৎসব (১৮৭৯), বিবাহ উৎসব (১৮৯২), নিবেদিতা (১৯১৭), পাকচক্র(১৯১১), যুগান্ত (১৯১৮)

শিশুপাঠ্য  ও অন্যান্য রচনা:

সচিত্র বর্ণবোধ (১৯০২), বাল্যবিনোদ (১৯০২), প্রথম পাঠ্য ব্যাকরণ (১৯১০)

কাব্য কবিতা:

গাথা(১৮৮০), হাসি ও অশ্রু (১৮৯৫)

পুরস্কার ও সাহিত্য: 

১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে জগওরিণী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের  সভাপতিত্ব করেন।

জীবনাবাসন:

স্বর্ণকুমারী দেবী নবী শতাব্দীর সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা জুলাই মারা যান।

 


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content