মহানায়ক উত্তম কুমারমহানায়ক উত্তম কুমার

মহানায়ক উত্তম কুমার : এক কিংবদন্তির জীবনী

Uttam Kumar

পরিচয়

মহানায়ক উত্তম কুমার, বাঙালি চলচ্চিত্রের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতা এবং ক্যারিশমা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন। তাঁর অভিনয় দক্ষতা, সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক প্রভাবশালী উপস্থিতির জন্য তিনি সর্বদাই শ্রদ্ধেয় এবং জনপ্রিয় ছিলেন।

প্রারম্ভিক জীবন

উত্তম কুমারের ( অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় )  জন্ম ৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে কলকাতার আহিরিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাতকারি চট্টোপাধ্যায় হুগলী জেলার বাসিন্দা ছিলেন এবং মাতা ছিলেন চপলা দেবী। উত্তম কুমারের পরিবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছিল, এবং তাঁর পিতা মেট্রো সিনেমায় একটি ফিল্ম প্রজেকশনিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। উত্তম কুমারের দুই ভাই ছিলেন, বরুণ ও তরুণ, যার মধ্যে তরুণও একজন অভিনেতা ছিলেন। তাঁর মাতামহী তাঁকে “উত্তম” নামক ডাকনামটি দেন।

শিক্ষা

উত্তম কুমার চক্রবেরিয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে সাউথ সাবার্বান স্কুলে পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলে থাকাকালীন তিনি “লুনার ক্লাব” নামক একটি থিয়েটার গ্রুপ গঠন করেন। তাঁর প্রথম অভিনয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “মুকুট” নাটকে পাঁচ বছর বয়সে, এবং এই অভিনয়ের জন্য তিনি একটি মেডেল পান। তিনি আবার গায়াসুর নাটকের জন্যও মেডেল পান।

উত্তম কুমার উচ্চ শিক্ষার জন্য গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এন্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ ভর্তি হন, কিন্তু পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে শেষ বর্ষে পড়া ছেড়ে দেন এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে ক্লার্ক হিসেবে যোগ দেন, যেখানে তিনি মাসে ২৭৫ টাকা বেতন পেতেন।

তিনি নিদানবন্ধু ব্যানার্জীর কাছ থেকে গান শিখেছিলেন। এছাড়াও তিনি লাঠিখেলা, যোগ, কুস্তি, ফুটবল, ভলিবল এবং ক্রিকেটে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ভবানীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনে তিন বছর ধরে সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তাঁর পরিবার একটি শৌখিন থিয়েটার গ্রুপ “সুহৃদ সমাজ” পরিচালনা করত।

ব্যক্তিগত জীবন

উত্তম কুমার ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো, তাঁর একটি বড়ো দিদি অকালেই পরলোক গমন করেন। ছোট ভাই তরুণ কুমার ছিলেন একজন শক্তিশালী অভিনেতা, এবং তাঁরা একত্রে অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের ছোটবেলা থেকে উচ্চারণে সমস্যা ছিল, যা তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠেছিলেন।

বিবাহ ও প্রেম

১৯৪৮ সালে উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গৌতমও মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। উত্তম কুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও একজন জনপ্রিয় অভিনেতা।

উত্তম কুমার ও গৌরী দেবীর মধ্যে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে প্রায়শই ঝগড়া হতো। পরবর্তীতে উত্তম কুমার সুপ্রিয়া দেবীর প্রেমে পড়েন এবং ১৯৬৩ সালে গৌরী দেবীকে ছেড়ে সুপ্রিয়া দেবীর সাথে দীর্ঘ ১৭ বছর বসবাস করেন।

আত্মজীবনী

উত্তম কুমার তাঁর আত্মজীবনী “হারানো দিনগুলি মোর” এবং পরে “আমার আমি” নামে লেখেন। ২০১৩ সালে তাঁর আত্মজীবনীর আসল কপিটি খুঁজে বের করা হয় এবং প্রকাশ করা হয়।

বিতর্ক

১৯৭৬ সালে উত্তম কুমার মহালয়ায় চণ্ডীপাঠ করার জন্য অল ইন্ডিয়া রেডিওর অফার গ্রহণ করেন, যা সাধারণত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র করতেন। কিন্তু দর্শকরা তাঁকে মেনে না নেওয়ায় উত্তম কুমার পরে তা বীরেন্দ্রবাবুকে ফিরিয়ে দেন। ২০১৯ সালে এই ঘটনা নিয়ে “মহালয়া” নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

কর্মজীবন

প্রাথমিক চলচ্চিত্র জীবন (১৯৪৭১৯৫১) উত্তম কুমার ১৯৪৭ সালে চলচ্চিত্রে যোগ দেন এবং প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘দৃষ্টিদান’ (১৯৪৮)। তাঁর প্রথম নায়ক চরিত্র ছিল ‘কামনা’ (১৯৪৯) ছবিতে, যেখানে তিনি নাম পরিবর্তন করে উত্তম চ্যাটার্জি রাখেন। কিন্তু তিনি ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ নামে পরিচিত হয়ে পড়েন।

প্রাথমিক সাফল্য (১৯৫২১৯৫৪) ১৯৫২ সালে ‘বাসু পরিবার’ ছবির মাধ্যমে সাফল্য পান। পরের বছর ‘শাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সাথে প্রথম জুটি বাঁধেন। ১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে ব্রেকথ্রু পান।

তারকা হয়ে ওঠা (১৯৫৫১৯৬৫) ১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’ ছবিতে অভিনয় করে তারকা খ্যাতি অর্জন করেন। ‘হ্রদ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রথম বিএফজেএ সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’ জাতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৬০ সালে ‘মায়া মৃগ’ এবং ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ সহ একাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনয় করেন এবং আবার ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘নায়ক’ ছবির জন্য বিএফজেএ সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান এবং ১৯৬৮ সালে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পান।

ভিন্ন ধরণের কাজ (১৯৬৬১৯৭৫) এই সময়ে তিনি চরিত্রাভিনয়ের দিকে মনোযোগ দেন। ১৯৭৪ সালে ‘অমানুষ’ ছবিতে অভিনয় করেন যা তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল ছবি হয়।

শেষ বছর (১৯৭৬১৯৮০) এই সময়ে তাঁর কর্মজীবন মন্দার দিকে যায়, কিন্তু ‘দুই পৃথিবী’ ছবির মাধ্যমে আবার সাফল্য পান। মৃত্যুর পর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওগো বধু সুন্দরী’ (১৯৮১) এবং ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবিগুলোও সফল হয়।

প্রযোজনা এবং পরিচালনা উত্তম কুমার ছয়টি বাংলা চলচ্চিত্র এবং একটি হিন্দি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন। তাঁর প্রযোজিত প্রথম দুটি ছবি ‘হারানো সুর’ এবং ‘সপ্তপদী’ জাতীয় পুরস্কার পায়।

সংগীত নাটক তিনি প্রথম গানে কণ্ঠ দেন ১৯৫০ সালের ‘মর্যাদা’ ছবিতে। ১৯৫৩ সালে তিনি ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয় করেন এবং এই নাটকটি ৪৮৬ রাত চলেছিল।

হিন্দি সিনেমা উত্তম কুমার ‘ছোটি সি মুলাকাত’ (১৯৬৭) ছবিতে প্রথম হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন, যা ব্যর্থ হয়। তাঁর একমাত্র সফল হিন্দি ছবি ছিল ‘অমানুষ’।

জনপ্রিয়তা সত্যজিৎ রায় তাঁকে আসল তারকা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ ছবিই সফল হয় এবং তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন।

সুচিত্রা সেন এবং অন্যান্য সহকর্মী সুচিত্রা সেনের সাথে তিনি ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন, যার মধ্যে ২৯টি সফল হয়। সুপ্রিয়া দেবীর সাথেও অনেক ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়াও সাবিত্রী চ্যাটার্জীর সাথে ৩৯টি ছবিতে কাজ করেছেন, যা সর্বাধিক।

বিতর্ক ১৯৭৬ সালে আকাশবাণীতে চণ্ডীপাঠ করার জন্য নির্বাচিত হন কিন্তু বিতর্কিত হন এবং পরে ক্ষমা চেয়ে আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ফিরিয়ে আনেন।

তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, যেগুলোর মধ্যে অনেক ছবিই কালজয়ী হয়েছে।

সাফল্য প্রতিষ্ঠা

উত্তম কুমার বাংলার চলচ্চিত্র জগতে এক মাইলফলক।  উত্তম কুমার একজন ঐতিহাসিক বাংলা চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন, যার অভিনীত ছবিগুলি অসাধারণ জনপ্রিয় এবং সাফল্যময় ছিল। তাঁর কর্মজীবনে অনেক বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করা হয়েছিল, যেমন রোমান্টিক, কমেডি, পুলিশ অফিসার, বিচারক, অভিজ্ঞানী এবং অন্যান্য। উত্তম কুমারের কাজের প্রায় ৫০টি ছবির মধ্যে ৩৯টি ব্লকবাস্টার, এবং তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ২০২টি। তাঁর সাফল্যের হার বেশি ছিল, এবং তিনি তার ক্ষমতা দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে এক অমূল্য অংশ হিসেবে থাকেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তাঁকে ‘মহানায়ক’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষমতা তাঁকে বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান দিয়েছে।

জুটি

উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করে এক চমৎকার জীবনী রচনা করেছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক ১৯৫৪ সালে তাদের প্রথম সহযোগিতা শুরু হয় এবং তারপর থেকে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র হিসেবে গড়ে উঠেন। ইন্দ্রানী, সপ্তপদী, প্রথম প্রযোজনা, আর তার পরের মধ্যে অনেক ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন যা বাংলা সিনেমার মধ্যে সন্তোষজনক সাফল্য এনে দিয়েছিল। উত্তম কুমারের অসামান্য রচনা ও সুচিত্রা সেনের উচ্চমান অভিনয় সম্মিলিত হয়ে তাদের চলচ্চিত্র জীবনের এক অমর অংশ হিসেবে ধরা হচ্ছে। উত্তম কুমারের সাথে সুচিত্রা সেনের জুটি ছিল অতুলনীয়। তাঁদের একসাথে করা প্রতিটি ছবি ছিল সুপারহিট, যেমন ‘সপ্তপদী’, ‘হারানো সুর’, ‘পথের আলো’ ইত্যাদি। তাঁদের রসায়ন এবং অভিনয় দক্ষতা দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

তারকা থেকে মহানায়ক

উত্তম কুমার সাধারণ অভিনেতা থেকে ধীরে ধীরে ‘মহানায়ক’ এ পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত, উত্তম কুমার বাঙালি চলচ্চিত্রের মহানায়ক হিসেবে অভিহিত হয়। ১৯৬৯ সালে একটি পত্রিকা তাকে প্রথম মহানায়ক ঘোষণা করে। তার এই কার্যকারিতা সম্মতিপ্রাপ্ত ছিল জনসাধারণের কাছেও। এই সময়ে বাংলার নকশাল আন্দোলনের সময়ে প্রশাসনিক দায়িত্বের জের জনজীবনে উত্তল হয়ে উঠতেছিল এবং এ পরিস্থিতির কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি হয়। এই সময়ে উত্তম কুমার একটি খুনের হুমকির কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন এবং বম্বেতে চলে গেলেন। তবে পরিবেশ শান্ত হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং তার চলচ্চিত্র কারিয়ার পুনরায় শুরু হয়।

শেষ বছরগুলো

উত্তম কুমারের শেষ বছরগুলো ছিল বেশ কঠিন। তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তবে তিনি শেষ দিন পর্যন্ত অভিনয় করে গেছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত, উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র পার্থক্যপূর্ণ ছিল। এই সময়ে তার বেশিরভাগ ছবি বক্স অফিসে অপেক্ষাকৃত ফেলে যেতেন, তবে কয়েকটি ছবি যেমন বহ্নিশিখা, সব্যসাচী, আনন্দ আশ্রম, ধনরাজ তামাং, সুননয়নী, দুই পৃথিবী সাফল্য লাভ করে। তারপরে তার চালানো ছবিগুলির সাফল্যের হার কমে যায় কারণ তিনি নিম্নমানের চিত্রনাট্যে কাজ করতেন। তবে, ১৯৮০ সালের জুনে মৃত্যুর আগে মুক্তি পেয়ে যায় ‘দুই পৃথিবী’ নামক ছবি। এটি তার কামব্যাক ছবি হিসেবে পরিচিত হয়।

মৃত্যুর পরবর্তী মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি

উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরেও তাঁর বেশ কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছিল, যেমন ‘অমানুষ’, ‘কালোজাই’, ‘অগ্নিসংযোগ’ ইত্যাদি। এই ছবিগুলিও দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে তার কিছু ছবি বিশাল সাফল্য লাভ করে। রাজা সাহেব হিসেবে প্রথম মুক্তি পান তিনি, যা তার চালিত ছবিতে অনুষ্ঠিত নেগেটিভ রোলের কারণে ফেলেও দর্শকের উন্মাদনার সামনে বিপর্যস্ত হয়। তবে অগ্রসর হয় বধু সুন্দরী নিয়ে, যা জনপ্রিয় হয়ে উঠে সমস্ত দর্শকের মধ্যে। এরপরে ‘সুর্য সাক্ষী’, ‘প্লট নাম্বার ফাইভ’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘প্রতিশোধ’, ‘দেশপ্রেমী’ সহ অন্যান্য ছবিও বক্স অফিসে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

জাত শিল্পীর পরিচয় সাফল্যের রেকর্ড

উত্তম কুমারের অভিনীত রোমান্টিক ও বাণিজ্যিক ছবিগুলি অত্যন্ত সফল ও জনপ্রিয় ছিল। তার প্রথম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি ছিল ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। তিনি বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে তার প্রতিভা প্রদর্শন করেছিলেন, যেমন কমেডি, ভিলান, পুলিশ অফিসার, জজ ও গোয়েন্দা ইত্যাদি ভূমিকায়। তার সঙ্গে কাজ করা ছিল প্রায় ৫০টিরও বেশি নায়িকার, যেগুলি তার সফলতার সাক্ষী হতে পারে। উত্তম কুমারের ছবিগুলির মধ্যে অনেকগুলি ব্লকবাস্টার হিসেবে জানা গেছে এবং তার সম্প্রসারণ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে।

উত্তম কুমার ছিলেন একজন প্রকৃত শিল্পী। তাঁর অভিনয় দক্ষতা, আবেগ এবং সংলাপ প্রক্ষেপণের ক্ষমতা তাঁকে সবার থেকে আলাদা করেছিল। তিনি অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য।

অন্যান্য ভূমিকায় উত্তম

উত্তম কুমার শুধুমাত্র অভিনেতা ছিলেন না, তিনি প্রযোজক, পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর প্রযোজনায় করা ছবি গুলিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

উত্তম কুমার ছিলেন একজন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক, তবে তাঁর কাজের বাইরে তাঁর অভিনয় ক্ষেত্র ছিল একটি অন্য জগত। তিনি ছিলেন একজন উৎকৃষ্ট গায়ক এবং সুরকার যিনি অনেক চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত করেছিলেন।

গায়ক সুরকার: উত্তম কুমার হিসেবে তাঁর গায়ক ও সুরকার হওয়ার জন্যে একাধিক প্রশংসা পায়েছিলেন। তিনি বাংলা ছবিতে অনেক গান গেয়েছিলেন এবং তাঁর গান সম্পর্কে বিশেষ ভাবে প্রশংসা হয়েছিল। তাঁর বেশিরভাগ গান তাঁর নিজের লিপে হয়েছিল এবং তাঁর সুরকার প্রদর্শন অসাধারণ হয়েছিল। উত্তম কুমার ছিলেন একজন সত্ত্বরতার সুরকার যিনি ছবির গানের প্রস্থানে অনেক সময় অভিনয়কারীদের পাশে বসে তাদের অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। তাঁর গানের সাথে তাঁর অভিনয়ও সমতুল্যভাবে ভালো ছিল।

অভিনেতা: ছবিতে উত্তম কুমার ছিলেন একজন দীর্ঘকালিন এবং জনপ্রিয় অভিনেতা। তিনি অনেকগুলি সফল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এবং তাঁর অভিনয়ও ভালো প্রশংসা পায়েছিল। উত্তম কুমারের বিখ্যাত ছবির মধ্যে “নীহারিকা” এবং “প্রযোজনা” উল্লেখযোগ্য। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে ছবিগুলির সাফল্য ছিল মহান।

পরিচালক: উত্তম কুমার ছিলেন একজন উৎকৃষ্ট পরিচালক এবং তাঁর নিজস্ব ছবির পরিচালকও ছিলেন। তিনি কিছু বাংলা ছবির জন্য পরিচালনা করেছিলেন এবং তাঁর পরিচালনা কাজও অনেক প্রশংসা পেয়েছিল।

পরিচালনা গান: উত্তম কুমার একজন সম্পূর্ণ শিল্পী ছিলেন যে গান ও অভিনয় দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর অসাধারণ কর্মক্ষমতা ছিল। তাঁর গানের সম্পর্কে অনেক মতামত আছে এবং তাঁর সুরকার প্রদর্শন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। একইভাবে, তাঁর অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর উচ্চ দক্ষতা ও সাফল্যের জন্য প্রশংসা পায়েছিলেন।

সমাজসেবা

উত্তম কুমার শুধুমাত্র সিনেমার পর্দার নায়ক ছিলেন না, বাস্তব জীবনেও একজন প্রকৃত নায়ক ছিলেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ১৯৪২ সালে গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন এবং প্রভাত ফেরী করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের আই এন এ ফান্ডের জন্য ‘আনন্দ মঠ’ নাটক মঞ্চস্থ করেন এবং সংগ্রহ করা ১৭৫০ টাকা নেতাজির বড় ভাই সতীশ চন্দ্র বসুর হাতে তুলে দেন। ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়েও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

উত্তম কুমার পশ্চিমবঙ্গের দুটি ভয়াবহ বন্যায় (১৯৬০ ও ১৯৭৮) সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি চাঁদা সংগ্রহ করেন, ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং সেই অর্থ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রদান করেন।

শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে, উত্তম কুমার গরীব শিশুদের স্কুলের বই কিনে দিতেন এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করতেন। পাড়ার সমস্যা বা ইন্ডাস্ট্রির যে কোনো ছোট সমস্যার দিকেও তিনি খেয়াল রাখতেন। দুঃস্থ কলাকুশলী ও শিল্পীদের জন্য তিনি ১৯৬৮ সালে ‘শিল্পী সংসদ’ গড়ে তোলেন এবং ‘বন পলাশের পদাবলী’ ছবির প্রযোজনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন।

উত্তম কুমার কখনো রাজনীতিতে আসেননি, তবে যেকোনো সরকারি তহবিলের প্রয়োজনে তিনি চাঁদা তোলাসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে রাজনীতির মেলবন্ধন তিনি কখনো চাননি, বরং শিল্পের মান উন্নয়নে এবং দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন।

চলচ্চিত্রের তালিকা

উত্তম কুমার প্রায় ২০০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে ‘নায়ক’, ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘হারানো সুর’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি।

উত্তম কুমারের চলচ্চিত্রের তালিকা

কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের নাম

  1. দৃষ্টিদান (1948)
  2. মর্যাদা (1950)
  3. বসু পরিবার (1952)
  4. সাড়ে চুয়াত্তর (1953)
  5. সাড়ে চুয়াত্তর (1953)
  6. অগ্নিপরীক্ষা (1954)
  7. সপ্তপদী (1961)
  8. সাগরিকা (1956)
  9. হারানো সুর (1957)
  10. চাওয়া পাওয়া (1959)
  11. সপ্তপদী (1961)
  12. সাগরিকা (1956)
  13. হারানো সুর (1957)
  14. পথের আলো (1957)
  15. শাপমোচন (1955)
  16. ইন্দ্রাণী (1958)
  17. ঝিন্দের বন্দী (1961)
  18. নায়ক (1966)
  19. চিড়িয়াখানা (1967)
  20. মেমসাহেব (1972)
  21. অমানুষ (1975)
  22. প্রতিধ্বনি (1964)
  23. দেয়া নেওয়া (1960)
  24. বিনাপাণি (1954)
  25. নীল আকাশের নীচে (1969)
  26. চৌরঙ্গী (1968)
  27. ধন্যি মেয়ে (1971)
  28. সন্ন্যাসী রাজা (1975)
  29. অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী (1967)
  30. স্ট্রাইকার (1978)

পুরস্কার এবং সম্মাননা

উত্তম কুমার অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভারতের জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদত্ত বিশেষ সম্মাননা।

উত্তম কুমারের কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা

  1. জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
    • সেরা অভিনেতা: চিরদিনের জন্য (1970)
  2. ফিল্মফেয়ার পুরস্কার (বাংলা)
    • সেরা অভিনেতা: এন্টনি ফিরিঙ্গী (1968)
    • সেরা অভিনেতা: চিড়িয়াখানা (1967)
  3. পদ্মশ্রী পুরস্কার
    • ভারত সরকারের দেওয়া চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা (উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন)
  4. BFJA (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) পুরস্কার
    • সেরা অভিনেতা: বসু পরিবার (1952)
    • সেরা অভিনেতা: সপ্তপদী (1961)
    • সেরা অভিনেতা: অগ্নিপরীক্ষা (1954)
    • সেরা অভিনেতা: সাগরিকা (1956)
    • সেরা অভিনেতা: ইন্দ্রাণী (1958)
    • সেরা অভিনেতা: হারানো সুর (1957)
  5. আনন্দলোক পুরস্কার
    • বিশেষ সম্মাননা: উত্তম কুমারের স্মৃতিতে
  6. কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
    • উত্তম কুমারের স্মৃতিতে বিশেষ প্রদর্শনী
  7. উত্তম কুমার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট
    • উত্তম কুমারের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পুরস্কার এবং সম্মাননা
  8. উত্তম কুমারের নামে মেট্রো স্টেশন
    • কলকাতার একটি মেট্রো স্টেশন উত্তম কুমারের নামে রাখা হয়েছে

মৃত্যু

উত্তম কুমারের মৃত্যু ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ঘটে। তাঁর প্রযোজিত হিন্দি ছবি “ছোটিসি মুলাকাত” চরম ব্যর্থতা এবং অতিরিক্ত দৈহিক পরিশ্রমের কারণে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। শেষবারের মতো তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন “ওগো বধু সুন্দরী” চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের সময়। শুটিং শেষে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়, যেখানে পরের দিন রাত ৯:৩৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর মৃত্যুতে গোটা বাংলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশজুড়ে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের শোকবার্তা আসতে থাকে। ২৫ জুলাই তাঁর শেষ যাত্রায় গোটা কলকাতা রাস্তায় নেমে আসে, যার ফলে বিশাল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর এই প্রথমবার বাংলায় এমন উন্মাদনা দেখা যায়। উত্তম কুমারের মৃতদেহ রবীন্দ্র সদনে রাখা সম্ভব হয়নি, এমনকি অর্ধেক দিনের জন্য বেসরকারি বন্ধ ঘোষণা করতে হয়। তাঁর শেষ কৃত্য কেওড়াতলা মহাশ্মশানে সম্পন্ন হয়।

তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ শোকাহত হয়েছিল।

বাংলা মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যম তাঁকে বিপুল স্মরণ করে, এবং তাঁর মৃত্যুদিন ও জন্মদিন প্রতি বছর পালন হয়।

উত্তরাধিকার

উত্তম কুমার একজন অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এবং সফল বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং অভিনয়ের জন্য তাকে ‘মহানায়ক’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছিল। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির অধিকাংশ মানুষ তাকে নিজের বাড়ির ছেলে হিসেবে ভাবতেন। তাঁর অভিনয় সম্পর্কে কথা হলে তার জনপ্রিয়তা মৃত্যুর পরেও অসীম ছিল।

উত্তম কুমারের অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, রাজ কাপুর ও হিম মুখার্জী সহ অনেক বিখ্যাত অভিনেতাদেরও মুগ্ধ করেছিল। তাঁর অভিনয় একটি ধরনের মুদ্রা ছিল যা বাংলা সিনেমায় নতুন একটি মানচিত্র তৈরি করেছিল। এক শতাব্দীর মহানায়ক হিসেবে উত্তম কুমারের স্মৃতি বাংলার চলচ্চিত্র জগতে চিরস্থায়ী হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

সম্মাননা

উত্তম কুমারকে মৃত্যুর পরেও বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ৩ অক্টোবরে ভারতীয় ডাক বিভাগ উত্তম কুমারের স্মরণে একটি স্মারক পোস্টাল স্ট‍্যাম্প প্রকাশ করে। কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ অঞ্চলে একটি স্টেশনের নাম দেওয়া হয় “মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশন”। ২০০৪ সালে টালিগঞ্জের ট্রাম্প ডিমোর পাশে তাঁর একটি লাইফ সাইজ ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়। পরে ২০১৭ সালে তাঁর জন্মস্থান ভবানীপুরে একটি ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও ২০২০ সালে তাঁর নামে বর্ধমান শহরে একটি শ্বেত পাথরের সাড়ে ছয় ফুটের ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ২০১২ সালে তাঁর নামাঙ্কিত “মহানায়ক” খেতাব দেওয়া হয় চলচ্চিত্রে আজীবন স্বীকৃতির জন‍্য। টালিগঞ্জে তাঁর নামাঙ্কিত একটি অডিটোরিয়াম আছে যা “মহানায়ক উত্তম মঞ্চ” নামে পরিচিত। এটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমানে কলকাতা মিনিসিপাল কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৮১ সালের মৃত্যুর পর থেকে প্রত‍্যেক বছরে উত্তম কুমারের মৃত্যুদিনে “উত্তম কুমার পুরস্কার” ঘোষণা করা হয়। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয় এবং তাঁর স্মরণে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

উপসংহার

মহানায়ক উত্তম কুমার এক অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং মানবিক গুণাবলী তাঁকে সকলের মনে চিরকালীনভাবে স্থাপন করেছে। উত্তম কুমার এক নাম নয়, এক ইতিহাস, এক কিংবদন্তি।

 


Discover more from My State

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Skip to content